ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন প্ল্যান সম্পর্কে আলোচনা করো: 1945 খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটেনের শ্রমিক দল শাসন ক্ষমতা লাভ করলে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে জাতীয় আন্দোলনের তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি তাঁর মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য স্যার প্যাথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস ও এ.ভি. আলেকজান্ডারকে ভারতে পাঠান। এই দলটি ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন (Cabinet Mission 1946) নামে পরিচিত। 1946 খ্রীঃ এর 24শে মার্চ ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন দিল্লিতে এসে পৌঁছায়।
ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ঘোষণা
দীর্ঘ 7 সপ্তাহ ধরে ভারতের 472 জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা ও 182টি বৈঠক করে 1946 খ্রিষ্টাব্দের 17ই মে ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এই পরিকল্পনায় বলা হয়-
1)ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে।
2)প্রদেশগুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে এবং কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব থাকবে।
3)হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলিকে ‘ক’, মুসলমান প্রধান প্রদেশগুলিকে ‘খ’ এবং বাংলা ও আসামকে ‘গ’ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে।
4)নতুন সংবিধান রচনার জন্য প্রত্যেক শ্রেণীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠন করা হবে।
5)নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।
ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা বিষয়ে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া-ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা মেনে নেয়। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে পৃথক পাকিস্তানের কথা না থাকায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিশেষ আপত্তি করেনি।তবে মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক নীতির প্রাধান্য থাকায় জাতীয় কংগ্রেস সংবিধান সভায় যোগ দিতে রাজি হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক নীতি অনুসারে প্রদেশগুলির শ্রেণীবিভাগ করায় তা পাকিস্তান গঠনের উপযোগী হবে বলে মনে করে মুসলিম লীগও এই প্রস্তাব মেনে নেয়।
ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবের ত্রুটি
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলিতে বেশ কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল-
1)পাকিস্তানের পদধ্বনি-মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে সরাসরি ভারত বিভাজন বা পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে স্বীকৃতি দেয়া না হলেও প্রদেশগুলিকে হিন্দু প্রধান ও মুসলমান প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করে পরোক্ষে ভারত বিভাজনের তথা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দরজা খুলে দেওয়া হয়।
2)দুর্বল যুক্তরাষ্ট্র-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারের তুলনায় দুর্বল করার ফলে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে।
3)দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের ঘোষণায় অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বাত্মক ক্ষমতা প্রদানের কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি।
4)দুর্বল সংবিধানসভা গঠনের প্রস্তাব-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের ঘোষণায় প্রস্তাবিত সংবিধান সভা বা গণপরিষদকে নতুন সংবিধান রচনার জন্য সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পরে অবশ্য মন্ত্রী মিশন একটি ইস্তেহার প্রকাশ করে জানায় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান সভাকে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ ক্ষমতা দেওয়া হবে।
ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের গুরুত্ব
বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবের গুরুত্বগুলি হলো-
1)অখন্ডতা রক্ষার প্রয়াস-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার শেষ আন্তরিক প্রয়াস। কারণ তাঁরা উপলব্ধি করেছিল যে ভারত বিভাজনের দ্বারা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে না।
2)দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের ঘোষণার দ্বারাই সর্বপ্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
3)গণপরিষদের ভারতীয়করণ-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের ঘোষণায় প্রস্তাবিত গণপরিষদে কোনো অভারতীয় সদস্য গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকার ফলে তাতে সম্পূর্ণ ভারতীয়করণ ঘটে।
4)গণপরিষদের ক্ষমতা-ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনের ঘোষণায় ঘোষণায় প্রস্তাবিত গণপরিষদকে বা সংবিধান সভাকে ভারতের নতুন সংবিধান রচনার জন্য সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।