পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর উভয় তীরে পাট শিল্প: পাটশিল্প হলো ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের একটি অতি প্রাচীন শিল্প। সমগ্র ভারতের মোট পাট শিল্পের প্রায় 78% গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিকটবর্তী হুগলি নদীর উভয় তীরে। প্রধানত হুগলি নদীর ডান তীরে উত্তরে কল্যাণী থেকে দক্ষিনে বাঁশবেড়িয়া এবং বাম তীরে উত্তরে বজবজ থেকে দক্ষিণে উলুবেরিয়া পর্যন্ত স্থানে পাট শিল্পের একদেশীভবন ঘটেছে। হুগলি নদীর বাম তীরে কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, নৈহাটি, টিটাগর, ভাটপাড়া, বজবজ, শ্যামনগর, কাঁকিনাড়া, বিড়লাপুর, জগদ্দল, খড়দহ, আগরপাড়া, খিদিরপুর, বাটানগর প্রভৃতি স্থানে এবং ডান তীরে বাঁশবেড়িয়া, ব্যান্ডেল, চুঁচুড়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, বৈদ্যবাটি, শ্রীরামপুর, রিষড়া, কোন্নগর, উত্তরপাড়া, বালি, বেলুড়, সাঁকরাইল, উলুবেড়িয়া প্রভৃতি স্থানে পাট শিল্প গড়ে উঠেছে। হুগলি নদীর উভয় তীরে পাট শিল্পের এই একদেশীভবনের কারণগুলি হল নিম্নরূপ-
১)কাঁচা পাটের সহজলভ্যতা: পাট শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হলো কাঁচা পাট। পশ্চিমবঙ্গের নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপন্ন হয়। এছাড়া জলপথ ও স্থলপথে আসাম ও বাংলাদেশ থেকেও এখনে প্রচুর পরিমাণে পাট আসে। ফলে এই অঞ্চলের পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচাপাটের অভাব হয়না।
২)অনুকুল জলবায়ু: নদী তীরবর্তী ও সমুদ্রের নিকটবর্তী অবস্থানের জন্য সারা বছরব্যাপী আর্দ্র সমভাবাপন্ন জলবায়ু হুগলি নদীর উভয় তীরে পাট শিল্প গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
৩)সুলভ জলের যোগান: পাট শিল্প গড়ে ওঠার জন্য যে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়, তা এখানকার হুগলি নদী থেকে সহজেই পাওয়া যায়।
৪)কলকাতা বন্দরের নৈকট্য: হুগলী শিল্পাঞ্চলের অনতি দূরেই কলকাতা বন্দর অবস্থান করার কারণে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করা সহজ হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি উৎপাদিত পাটজাত দ্রব্য রপ্তানিরও সুবিধা হয়েছে।
৫)উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা: কলকাতা বন্দর, হুগলি নদী ও তার উপনদীগুলির অভ্যন্তরীণ জলপথ; পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব রেল পথ, ২, ৬ ও ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক পথ এবং একাধিক রাজ্য সড়ক পথের মাধ্যমে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা হুগলি নদীর উভয় তীরের পাট শিল্পের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
৬)শক্তি সম্পদের প্রাচুর্য: আসানসোল, রানীগঞ্জ ও ঝরিয়া অঞ্চলের কয়লার সাহায্যে ব্যান্ডেল ও কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত তাপবিদ্যুৎ এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের জলবিদ্যুৎ এই অঞ্চলের পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় শক্তি সম্পদের তথা বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে।
৭)দক্ষ শ্রমিকের প্রাচুর্য: পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বিহার, ঝারখন্ড, উড়িষ্যা, ছত্রিশগড় ইত্যাদি ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্যগুলি থেকে হুগলি শিল্পাঞ্চলের পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় কর্মঠ ও দক্ষ শ্রমিক সহজে ও সুলভে পাওয়া যায়।
৮)মূলধনের প্রাচুর্য: প্রাথমিক অবস্থায় ইংরেজরা এখানকার পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধন বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশীয় শিল্পপতি, ব্যাংক, বীমা সংস্থা ও বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থা এখানকার পাট শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের যোগান দেয়।
৯)চাহিদা: দেশে ও বিদেশে প্যাকেজিং এর কাজে বা মোড়ক দ্রব্য হিসাবে এখানকার পাটজাত দ্রব্যের ব্যাপক চাহিদা আছে। দেশে-বিদেশে পাটজাত দ্রব্যের এই ব্যাপক চাহিদা হুগলি নদীর উভয় তীরবর্তী পাট শিল্পের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে।