বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Sheikh Mujibur Rahman Biography in Bengali. আপনারা যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
শেখ মুজিবুর রহমান কে ছিলেন? Who is Sheikh Mujibur Rahman?
শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ই মার্চ ১৯২০ – ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫) শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু, ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারত বিভাজন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। শুরুতে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি, এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রয়াস এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশের “জাতির জনক” বা “জাতির পিতা” হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও তাকে প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসাধারণের কাছে তিনি “শেখ মুজিব” বা “শেখ সাহেব” নামে এবং তার উপাধি “বঙ্গবন্ধু” হিসেবেই অধিক পরিচিত। তার কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনী – শেখ মুজিব | Sheikh Mujibur Rahman Biography in Bengali
নাম | শেখ মুজিবুর রহমান |
জন্ম | 17 মার্চ 1920 |
পিতা | শেখ লুৎফুর রহমান |
মাতা | সায়েরা খাতুন |
জন্মস্থান | টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ মহকুমা, ফরিদপুর জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান টুঙ্গিপাড়া উপজেলা, গোপালগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ) |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
পেশা | বাংলাদেশের জাতির জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি |
মৃত্যু | 15 আগস্ট 1975 (বয়স 55) |
শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম: Sheikh Mujibur Rahman’s Birthday
শেখ মুজিবুর রহমান 17 মার্চ 1920 জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Sheikh Mujibur Rahman’s Parents And Birth Place
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম ১৯২০ খ্রিঃ ১৭ ই মার্চ। ফরিদপুর জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম লুৎফর রহমান। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়েও ছাত্রাবস্থাতেই মুজিবর দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত হন।
শেখ মুজিবুর রহমান এর শিক্ষাজীবন: Sheikh Mujibur Rahman’s Educational Life
১৯৪২ খ্রিঃ ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিকও ১৯৪৭ খ্রিঃ কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি নিখিল ভারত মুসলিম স্টুডেন্টস লিগের সদস্যভুক্ত হন ৷ সেদিনে কলকাতায় ছাত্রনেতাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ফজলুলকাদের চৌধুরী, কাজী আহমদ কামাল, মহিরুদ্দিন প্রমুখ ছিলেন মুজিবরের প্রধান সঙ্গী।
শেখ মুজিবুর রহমান এর কর্ম জীবন: Sheikh Mujibur Rahman’s Work Life
১৯৪৩ খ্রিঃ তিনি অবিভক্ত বাঙ্গলাদেশের মুসলিম লিগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল মুসলিম লিগের রাজনীতি দিয়ে। এই রাজনীতিতে ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণা অপর পক্ষে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবি। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুকালের মধ্যেই তিনি প্রথম ধারণা থেকে সরে এসেছিলেন। মুজিবের চিন্তা জগতের এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল প্রথমে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে পরে মওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন।
বস্তুতঃ তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্ব খন্ডিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিঃ শরবসু ও কিরণশংকর রায়ের সঙ্গে যখন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম সার্বভৌম অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই বছরই করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লিগের সর্বশেষ কাউন্সিল অধিবেশন। এই সভায় সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লিগের নীতির সংস্কারের প্রস্তাব করেন। তিনি চেষ্টা করেন সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকদের প্রবেশাধিকার যুক্ত একটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত করতে। দুঃখের বিষয়, তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পূর্ববঙ্গ সরকার সোহরাওয়ার্দীর ওপর নানা প্রকার বাধানিষেধ আরোপ করেন। শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলা থেকে তাকে বহিষ্কৃত হতে হয় ৷ সোহরাওয়ার্দী চলে যান করাচিতে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। এই প্রশ্নেই তার সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর মতভেদ হয় পরে। তখন সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তার ইঙ্গ মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির জন্যও তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এর ফলে আওয়ামী লিগের ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভাসানী দল থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি। স্বায়ত্ত শাসনের প্রশ্নে মুজিব ছিলেন মৌলানা ভাসানীর অনুসারী।
তিনি দলত্যাগ না করে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগে সাধারণ সম্পাদক হয়ে থেকে যান। ১৯৬৩ খ্রিঃ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে মুজিবই হলেন আওয়ামি লিগের সর্বেসর্বা। এবারে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তিনি হয়ে উঠলেন ভাসানীর চাইতেও সোচ্চার। তারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ খ্রিঃ উত্থাপিত ছয়দফা কর্মসূচির মধ্যে। মুজিবের ছয়দফা ঘোষণা বাঙ্গালীকে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। মুজিবের মতে ছয় দফা ছিল বাঙ্গালীর মুক্তির জাতীয় সনদ। ইতিপূর্বে ১৯৫২ খ্রিঃ ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে প্রায় আড়াই বছর কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছিল মুজিবকে।
এছাড়া ১৯৫৪ খ্রিঃ পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে গেলে বহু রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৮ খ্রিঃ আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করলে বহুবার মুজিবকে কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছিল। তাই কারাবরণ মুজিবের কাছে নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু ছয়দফা কর্মসূচি উত্থাপনের পরে তাঁকে যেভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছিল তার কোন তুলনা হয় না। সারা পূর্বপাকিস্তান জুড়ে সেই সময় মুজিব ঘুরে ঘুরে জনসাধারণকে ছয়দফা কর্মসূচি বুঝিয়েছেন। কিন্তু যেখানে যেখানে তিনি সভা করেছেন সেখানেই সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে — তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কখনো যশোর থেকে তো দুদিন বাদে সিলেট কিংবা ঢাকা থেকে, পরদিন চট্টগ্রাম থেকে — এভাবে বার বার গ্রেফতার করে তাকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশে ছাড়া পেয়েছেন, কিন্তু পরে পরেই আবার অন্য মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। সরকার এভাবে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে গেছে মুজিবকে জনসাধারণের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু এই হয়রানির খেলায় সম্ভবতঃ পাকিস্তান সরকার এক সময় স্বয়ং হয়রান হয়ে পড়েছিল। তাই মুজিবকে আটক করবার নতুন এক চাল চালল। দাঁড় করিয়ে দিল মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে মুজিবকে দাঁড় করানো হলো এক নম্বর আসামি হিসেবে। ১৯৬৮ খ্রিঃ এই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে প্রেসিডেন্ট আয়ুব মুজিবকে কুর্মিটোলায় মিলিটারি জেলে বন্দি করে রেখেছিলেন। পরের বছরেই অবশ্য ছাড়া পেলেন মুজিব। মুক্তিলাভের পরে ১৯৬৯ খ্রিঃ ঢাকায় মুজিবকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানেই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু আখ্যায় ভূষিত করা হয়। এই সময় থেকেই মুজিব হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৯ খ্রিঃ মুজিব কিছুদিনের জন্য লন্ডন যান। পরে গোলটেবিল বৈঠকে রাওয়ালপিন্ডি উপস্থিত থাকেন। ওই বছরেই গণ আন্দোলনের চাপে আয়ুব খানের পতন ঘটে।
পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯ খ্রিঃ আওয়ামি লিগের কর্মসূচিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষিত হয়। ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি কাজের মধ্য দিয়ে কাছাকাছি এসেছিল। এবারে সেই সম্পর্ক আরও সন্নিকট হবার বাতাবরণ তৈরি হল। ১৯৭০ খ্রিঃ সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। নির্বাচনে আওয়ামি লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়লাভ করে। এই বিজয়ী দলের নেতা ছিলেন মুজিব।
পাকিস্তানে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিঃ প্রথমবার। নির্বাচনের আগে ভাসানী দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে ভাগের আগে জাতের দাবি উত্থাপন করলেন। কিন্তু তার ডাকে মানুষ সাড়া দেয়নি। এই নির্বাচনে দেশের মানুষ যেভাবে আওয়ামি লিগকে সমর্থন দেয় তা সংসদীয় ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মহিলা আসন সহ জাতীয় পরিষদে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০ টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টি আসন লাভ করেছিল আওয়ামি লিগ।
নির্বাচিত সদস্যরা প্রকাশ্যে শপথ নেন, তাঁরা ছয় দফার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবেন। ভাসানী আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানান। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। কিন্তু পরিষদে সংখ্যালঘু হয়েও তিনি দাবি জানালেন, তাঁর দলের সম্মতি ছাড়া কোনও সংবিধান রচিত হতে পারবে না। ভুট্টো কৌশলে নিজের পক্ষে সমর্থন আদায় করলেন উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের।
স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ও সামরিক আইন প্রশাসক ভুট্টোর সঙ্গে একমত হলে জাতীয় পরিষদের আহ্বত অধিবেশন রাষ্ট্রপতি স্থগিত করলেন। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্রপতির ঘোষণার বিরুদ্ধে মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিঃ ১ লা মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ব্যাপক গণ – বিক্ষোভ চলে পূর্বপাকিস্তানে। ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত যে অসহযোগ আন্দোলন চলে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মার্চ মাসের সাত তারিখে এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম — এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এই ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাই জানিয়েছিলেন। তবে সংসদীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা তিনি ভঙ্গ করেননি। পূর্ণ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থেকে বিরত ছিলেন। এই ঘোষণার পর থেকে ক্যান্টনমেন্টও গভর্নর ভবনের বাইরে পূর্বপাকিস্তানের কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। জঙ্গী শাহীর হুমকির জবাবে ১৯৭১ খ্রিঃ ১৫ মার্চ মুজিব একটি ঘোষণাদ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ শাসনভার নিজের হাতে গ্রহণ করেন। বাঙ্গলাদেশের জনগণের মুক্তির উদ্দেশ্যই তার এই কাজে প্রতিফলিত হয়।
পরদিন থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয় নির্মম জঙ্গী নিষ্পেষণ। ২৫ শে মার্চ রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপরে। সম্ভবতঃ তার আগেই মুজিব আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন কিংবা সে ঘোষণা তার নামে ২৬ শে মার্চ প্রচারিত হয়েছিল। ২৫-২৬ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা চলে ওই তারিখেই জন্ম নিয়েছিল নতুন এক জাতি।
পশ্চিম পাকিস্তানেই শুরু হয়েছিল মুজিবের প্রহসন মূলক বিচারের আয়োজন। যে জেলে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তার সামনে তার চোখের সামনেই তার কবর খনন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহু অত্যাচার অসংখ্য হত্যার পর মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হয় এবং বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় ১৯৭১ খ্রিঃ ১৬ ই ডিসেম্বর। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেছিল ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্যে। এর পরেই পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সরিয়ে ভুট্টো রাষ্ট্রপতির আসন দখল করেন।
বিশ্ব জনমতের চাপে তিনি মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ১৯৭১ খ্রিঃ ১০ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রত্যাবর্তন করেন স্বাধীন স্বদেশে এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নবীন রাষ্ট্রের কর্ণধার রূপে মুজিবের প্রধান কৃতিত্ব হল ১৯৭১ খ্রিঃ একটি সংবিধান রচনা। এই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ঘোষিত হয় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। তার অপর কৃতিত্ব হল ১৯৭১ খ্রিঃ জুনে সপেক্ষাকৃত অবাধ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন।
তবে একথা সত্যি যে তার কাছে মানষের যে প্রত্যাশা ছিল তার অনেকটাই পূরণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল যা হয়েছিল তা হল দেশের মধ্যবিত্তের স্বপ্নের সঙ্গে নিম্নবিত্তদের আশা – আকাঙ্ক্ষাও যুক্ত হয়েছিল। তবে এই দুয়ের মধ্যে বিরোধও ছিল অনেক ক্ষেত্রে। সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধের ফলে অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। বিভিন্নভাবে তার প্রায়োগও হচ্ছিল নানা দিকে। অনিবার্য ভাবেই দেশে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। এর পেছনে সরকার সমর্থকদেরও যে মদত ছিল না তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
ফলে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদীদের ভিড় ক্রমশই শক্তি কেন্দ্রে বৃদ্ধি পেতে থাকে। নানা কারণে নতুন সরকারের প্রতি সামরিকবাহিনীও সন্তুষ্ট রইল না। এই সময়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অস্থিরতার ফল স্বরূপ দেশজুড়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষাবস্থা। ১৯৭১ খ্রিঃ ডিসেম্বরে শেখ মুজিব সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ও রাষ্ট্রপতির সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করলেন। নিজেই দায়িত্ব নিলেন রাষ্ট্রপতির।
এই ব্যবস্থার ফলে অবশ্য মুজিবের বাড়তি কোন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়নি। কেননা জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব তারই ছিল, দলেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এই ব্যবস্থার দ্বারা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য তিনি এতকাল সংগ্রাম করেছেন, সেই পথ থেকে সরে এলেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার পরেই সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের তিনি রাজনীতিতে নিয়ে এলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এর মৃত্যু: Sheikh Mujibur Rahman’s Death
১৯৭১ খ্রিঃ ১৫ আগস্ট কিছু সংখ্যক প্রাক্তন ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন। নৃশংস ছিল এই হত্যাকান্ড। শুধু মুজিব নয়, তাঁর স্ত্রী, পুত্রদের সঙ্গে পুত্রবধূরা, আত্মীয়স্বজনসহ বাড়িতে উপস্থিত দলের কতিপয় কর্মী — ঘাতকরা কাউকেই রেহাই দেয়নি। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। আর শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশের জনক হয়েই তিনি বাঙ্গালির হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
১৯৯৫ খ্রিঃ বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়েল ট্রাস্টের উদ্যোগে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেমোরিয়াল যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্মৃতি যাদুঘর রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেসার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬১ খ্রিঃ নির্মিত হয়েছিল এই বাড়ি। ওই বছরই ১ লা অক্টোবর বঙ্গবন্ধু সপরিবারে এই বাড়িতে বসবাস করতে আসেন। তখন থেকেই এই বাড়িটি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল।
দেশের ও বিদেশের বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং জ্ঞানীগুণী মনীষী জনের আগমন ঘটেছে এই ঐতিহাসিক বাড়িতে। ১৯৬২ খ্রিঃ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা, ১৯৬৬ খ্রিঃ ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ খ্রিঃ মহান গণঅভ্যুত্থান এই বাড়ি থেকেই উৎসারিত। এই বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিঃ ঐতিহাসিক সফল নির্বাচন। পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৬২ খ্রিঃ থেকে ‘৬৬ খ্রিঃ পর্যন্ত অসংখ্যবার এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে। ১৯৭১ খ্রিঃ দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমলা শ্রেণী ইয়াহিয়ার সামরিক হুকুম অগ্রাহ্য করে যে নির্দেশনামা পালন করত তা বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি থেকেই পাঠাতেন। তার সেই নির্দেশনামার ভিত্তিতেই অফিস – আদালত, ব্যাঙ্ক – বীমা সব সংস্থা পরিচালিত হত।
এই বাড়ি কেবল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হিসেবেই স্মরণীয় নয়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। মুক্তিলাভের পর এই বাড়িতে বসেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকার সময়েই ১৯৭৫ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতেই সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন।