সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর জীবনী – Subrahmanyan Chandrasekhar Biography in Bengali

Rate this post

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Subrahmanyan Chandrasekhar Biography in Bengali. আপনারা যারা সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর সম্পর্কে জানতে আগ্রহী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

Table of Contents

সুকুমার রায় কে ছিলেন? Who is Subrahmanyan Chandrasekhar?

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (তামিল: சுப்பிரமணியன் சந்திரசேகர்) (১৯ অক্টোবর ১৯১০- ২১ আগস্ট ১৯৯৫) ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। তিনি এক তামিল পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তারার বিবর্তন এবং জীবন চক্র সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্য তাকে উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলারের সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তারার বিবর্তন বিষয়ে তার আবিষ্কৃত বিষয়টির নাম চন্দ্রশেখর সীমা।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর জীবনী – Subrahmanyan Chandrasekhar Biography in Bengali

নামসুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর
জন্ম19 অক্টোবর 1910
পিতাচন্দ্রশেখর সুব্রহ্মণ্য আয়ার
মাতা
জন্মস্থানলাহোর, পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পাঞ্জাব, পাকিস্তান)
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারত (১৯১০-১৯৪৭)
ভারত (১৯৪৭-১৯৫৩)
যুক্তরাষ্ট্র (১৯৫৩-১৯৯৫)
পেশাজ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী
মৃত্যু21 আগস্ট 1995 (বয়স 84)

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর জন্ম: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Birthday

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ১৯১০ সালের ১৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Parents And Birth Place

যে সব বিজ্ঞান – মনীষীর জীবন – সাধনার আলোয় যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতা আলোকিত হয়েছে, পেয়েছে অগ্রগমনের বেগ, সেই মহাবিজ্ঞানীদের একজন সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখর। তিনি তার গণিতশাস্ত্রের হিসেব দিয়ে মহাকাশের জ্যোতি মন্ডলের রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। তাঁর অচিন্তনীয় গবেষণার দানে সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্ববিজ্ঞানের ভান্ডার।

তাঁর গবেষণার ফলেই আজ আমাদের কাছে পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়েছে নক্ষত্রের গঠন, নক্ষত্রের জীবনচক্র, নক্ষত্রের শেষ পরিণতি, ব্ল্যাকহোল প্রভৃতি তত্ত্ব সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্য। তাঁর সাধনার আলোয় আলোকিত হয়েছে বিশ্ববিজ্ঞানের অঙ্গন, গৌরবদীপ্ত হয়েছে স্বদেশ – স্বজন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যম হয়ে চন্দ্রশেখরকে অভিনন্দিত করেছে ১৯৮৩ খ্রিঃ পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার। অবিভক্ত ভারতের লাহোরের এক তামিল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন চন্দ্রশেখর ১৯১০ খ্রিঃ ১০ ই অক্টোবর।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর শিক্ষাজীবন: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Educational Life

পরবর্তীকালে তাঁদের পরিবার লাহোর ছেড়ে চলে আসে মাদ্রাজে। এখানেই শুরু হয় চন্দ্রশেখরের শিক্ষাজীবন। শিক্ষার আলোকে আলোকিত পারিবারিক পরিবেশে মা ও বাবার উৎসাহেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিলেন চন্দ্রশেখর। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল তার পড়ার অভ্যাস। মনের মত বই পেলে নাওয়া – খাওয়া ভুলে ডুবে যেতেন সেই বইতে।

বিজ্ঞানীর জীবন – কথা, আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর গল্পের প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করতেন চন্দ্রশেখর। এই ভাবেই একদিন তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল রসায়ন, অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যার মুক্ত অঙ্গনের প্রান্তে। এসব বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় আপনা থেকেই আগ্রহ বাড়ল অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যার বইয়ের দিকে। স্কুল লাইব্রেরিতে এই সম্পর্কে যত বই ছিল, একে একে খুঁজে খুঁজে সব পড়া হয়ে গেল তার।

কতক বুঝলেন, কতক বুঝলেন না, সব সমাধানেরই নাগাল পেলেন এমনও নয় — কিন্তু তাতে আকর্ষণ টলল না এতটুকু। চন্দ্রশেখরের পরিবারেও সেই রেওয়াজ। নিজের বাবা উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত। এক কাকা সি.ভি.রামন দুরম্ভ বিজ্ঞান প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ১৯১০ খ্রিঃ অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত আর চাকরিতে থাকেননি।

কলকাতার কালটিভেশন অব সায়েন্সে গবেষণায় মেতে গিয়েছিলেন। পরে গবেষণার স্বার্থে সরকারি চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের কাজ নিয়েছিলেন। সেই কাকাই ১৯৩০ খ্রিঃ রমন – বর্ণালী আবিষ্কারের সূত্রে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। চোখের সামনেই রয়েছে এমন একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কাজেই বিশেষ চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন হল না, ভবিষ্যতের পথ নির্দিষ্ট করে ফেললেন।

পরিবারের আর্থিক অবস্থার চাহিদা অগ্রাহ্য করেই চাকরির চিন্তাভাবনা প্রয়োজন হল না। চন্দ্রশেখর নিজের মাথা থেকে দূর করলেন। যে করেই হোক তাঁকেও বিশ্ববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ স্থানটি দখল করতে হবে। নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে। এজন্য যদি আর্থিক কৃচ্ছতায় চরম দুঃখকেও বরণ করতে হয় তিনি পেছপাও হবেন না।

প্রেসিডেন্সিতে পড়বার সময় সহপাঠিনীরূপে পেয়েছিলেন ললিতাকে। তার উৎসাহই প্রেরণা জোগাল চন্দ্রশেখরকে। ললিতা তার বিজ্ঞান প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাবতী। সে – ও স্বপ্ন দেখে, বিশ্ববিজ্ঞান সভায় একদিন স্বীকৃতি লাভ করবেন চন্দ্রশেখর। লতিতার প্রেরণাতেই রামন ছাত্র – বৃত্তির ব্যবস্থা করে নিলেন ঘোরাঘুরি করে।

১৯৩১ খ্রিঃ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন ইংলন্ডে। এখানে এসে গবেষণা শুরু করলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই, ২৩ বছর বয়সে ডক্টরেট হলেন। এতদিনে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় হাত দিয়েছেন চন্দ্রশেখর। এই সময় এই বিভাগে দোর্দন্ড প্রতাপে বিরাজ করছেন এডিংটন, ডিব্র্যাক, বোর, বেখে, মিলনে, কম্পটন ও সোমারফিন্ডের মত পদার্থবিদ্যার স্বনামধন্য প্রতিভা।

রিজ্ঞানীরা তখন মেতে উঠেছেন মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের পরিচয় উদ্ঘাটনের চেষ্টায়। যে প্রশ্ন তাদের বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে তা হল, মহাজগতের দেদীপ্যমান সংখ্যাতীত নক্ষত্রমন্ডলী — এদের অবস্থান কি নিত্য অপরির্তনীয় ? আর এদের অন্তহীন আলোর উৎসই বা কি ? সূর্য সম্পর্কে ততদিনে পদার্থবিদরা জেনে গেছেন যে আবহমান কালের অমিততেজ যে সূর্য, তার আলোর রহস্য আর কিছুই নয় সূর্যের ভেতরের এক তেজস্ক্রিয় ঘটনারই পরিণতি।

অঙ্ক পেলেই কোমর বেঁধে কষতে বসে যান। যত দুরূহ হয় অঙ্কের সমাধান ততই তার উৎসাহ বৃদ্ধি হয়। সমস্যা নিয়ে বিভোর হয়ে থাকতেই যেন তার আনন্দ। এই যে ছেলের অবস্থা তার কৈশোরের চাঞ্চল্য প্রকাশ করবার সুযোগ কতটুকু ? সহপাঠীরা যেই সময়ে খেলাধুলায় বা অন্য আমোদ – আহ্লাদে সঙ্গীদের নিয়ে মেতে থাকছে, সেই সময়ে ঘরের বা লাইব্রেরির নিভৃতে বসে বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের পাতার পর পাতা উল্টে তার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করার কাজে ব্যস্ত চন্দ্রশেখর।

এই ভাবেই চন্দ্রশেখর আধুনিক পদার্থবিদ্যার যুগান্তকারী ঘটনাগুলির সঙ্গে পরিচিতি লাভ করলেন। রন্টজেনের এক্স – রে, জে.জে.টমসনের ইলেকট্রন, কুরি পরিবারের তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ও পোলনিয়াম, রাদার ফোর্ডের পরমাণুর কেন্দ্রকণা নিউক্লিয়াস ইত্যাদির নাগাল ধরে ফেললেন তিনি একে একে। এই সব জগৎ – কাঁপানো আবিষ্কারের সূত্র ধরে কাজ করে চলেছেন দুই জগদ্বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আর্নল্ড সোমার ফিল্ড এবং আর্থার কম্পটন। আধুনিক পদার্থবিদ্যায় তাঁদের নতুন নতুন ব্যাখ্যা বিজ্ঞান জগতে থেকে থেকে তুলছে আলোড়ন ৷

এই সব তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তরুণ চন্দ্রশেখর। মাত্র আঠার বছর বয়সেই পদার্থবিদ্যার নানা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার অভ্যাস তৈরি হয়ে ওঠে তার। এক সময়ে গণিতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করে ফেললেন আধুনিক পদার্থবিদ্যার এক জটিল তত্ত্ব। অন্ধিসন্ধি কিছুই তার অজানা নয়। প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স নামের বিজ্ঞান পত্রিকায়। যথাসময়ে প্রবন্ধটি ছাপাও হল বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে।

মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে চন্দ্রশেখর বি.এ. পাশ করলেন ১৯২৮ খ্রিঃ। ততদিনে গাণিতিক পদার্থবিদ্যার ওপরে একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ তৈরি হয়ে গিয়েছে তাঁর। বইকে সঙ্গী করে নিজেই পথ দেখিয়ে চলেছেন নিজেকে। স্নাতকোত্তর পাঠ নেবার জন্য মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন চন্দ্রশেখর। এবারে আধুনিক পদার্থবিদ্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে উঠল। এল ১৯৩০ খ্রিঃ। পদার্থ বিদ্যায় এম.এ পাশ করলেন চন্দ্রশেখর। এই সময় তার বয়স ত্রিশ।

এবারে বাইরের জগতে সঞ্চরণের পালা। দুস্তর পথ সামনে, বিস্তৃত আকাশ মাথার ওপরে। সেই সময়ে এম.এ পাশ করবার পর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা লোভনীয় সরকারী চাকরির লোভে প্রথমেই প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় বসে যেত। প্রতিনিয়ত সেখানে চারটি করে হাইড্রোজেন পরমাণুর সম্মিলনে গড়ে উঠছে একটি হিলিয়াম পরমাণু, আর হাইড্রোজেনের অবশিষ্ট ভর রূপান্তরিত হচ্ছেশক্তিতে। এই শক্তিই সূর্যকিরণ হয়ে পৃথিবীতে জেগে রয়েছে সমস্ত শক্তির উৎস হয়ে।

এই সূত্র ধরেই এগিয়ে চলার পথ পেয়ে যান চন্দ্রশেখর। তাঁর মনে হয় নক্ষত্রের আলোকের ব্যাখ্যাও কি সূর্যেরই অনুরূপ ? এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে সমকালীন বিজ্ঞানীদের গবেষণা হাতড়াতে শুরু করলেন চন্দ্রশেখর ৷ পেয়ে গেলেন লিউক্রিটাস নামের এক পদার্থবিদের সন্ধান। তিনি এক জায়গায় স্পষ্ট নির্দেশ করেছেন, We must belive that Sun Moon and Stars emit light, from fresh and ever fresh supplies rising up .

কোন এক সদ্যোজাত শক্তির ভান্ডার থেকে আহৃত আলোই সূর্য, চন্দ্র ও তারা বিকীরণ করে চলেছে। এ পর্যন্ত এসেই লিউক্রিটাস ও অন্যান্য পদার্থবিদগণ থমকে গেছেন। যেটাকে তাঁরা সদ্যোজাত শক্তি বলেছেন, সেই শক্তির প্রাকৃতিক ভান্ডারের রহস্য সম্পর্কে কোন আলোকপাত করতে পারেন নি। তখনো পর্যন্ত নিউক্লিয়ার এনার্জি বা পরমাণু শক্তির রহস্য জানা ছিল না বলেই পদার্থবিদগণ শক্তির প্রাকৃতিক উৎসের রহস্যের কূলকিনারা করতে পারেন নি।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর প্রথম জীবন: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Early Life

গবেষণায় নেমে চন্দ্রশেখর নক্ষত্রের প্রকৃত জীবনচক্র ব্যাখ্যায় পরমাণুর আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্বকে আশ্রয় করে একে একে গণিত মডেল তৈরি করে চললেন। তিনি দেখতে পেলেন, সৌরবিশ্বের সূর্যের মত, মহাবিশ্বের নক্ষত্ররা নিজেদের আলো সমানভাবে বিকিরণ করতে পারছে না। সেখানে আলোর ক্ষয়িষ্ণুতা বর্তমান। এছাড়া এদের অবস্থানও যে নিত্যকালের জন্য এ ধারণারও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

তাদের অভ্যন্তরস্থ পরমাণু কেন্দ্রক নিঃসৃত শক্তি কমতে কমতে একদিন যে নিঃশেষ হয়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেইকালে নক্ষত্রের গভীরে ঘটবে গঠনগত বিশাল এক পরিবর্তন। সৌরপদার্থের ভেতর থেকে সেই পরিবর্তন নিয়ে আসবে এক অভাবিত রূপান্তর গোটা নক্ষত্র জুড়ে। এভাবেই শেষ হবে নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল।

কিন্তু যেহেতু নক্ষত্র, তার শেষের সে দিনও দীর্ঘায়িত অসম্ভব রকমের। হাতের কাছে সূর্যই হল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, কমবেশি পঞ্চাশ কোটি বছর আগে। এই সময় সীমার বহু কোটি বছর আগে থেকেই, পৃথিবীর বুকে আলো ছড়িয়ে চলেছে সূর্য, এখনো তেজে – বিক্রমে সে অনন্য। আসলে মহাজাগতিক আলো ও মহাকর্ষজ টান থেকে উপজাত বলেই এই আলো ও তাপ নিয়ে নক্ষত্রেরা অমিত আয়ুষ্মান।

এই ভাবেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে চলেন চন্দ্রশেখর। যত অগ্রসর হন, ততই দেখতে পান নক্ষত্রদের গঠনগত সর্বশেষ রূপান্তর একই রকমের। প্রথমে ঘটে অভ্যন্তর ভাগের ক্রমঃসঙ্কোচন। এই টানই নক্ষত্রের ওপরের অংশে ঘটায় প্রসারণ। বাইরের দিকের প্রসারণ ও ভেতর ভাগের সংকুচিত দশায় অতিকায় আকারে মহাবিশ্বে ধাবমান থাকে। সেই অবস্থায় তার চারপাশে নাগালের মধ্যে যত গ্রহ উপগ্রহ থাকে সব কিছুকেই আত্মসাৎ করে।

কোনও এক সূদূর ভবিষ্যতে সূর্যেরও যখন এমনি পরিণতি আসবে তখন তার সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রহ বুধ সবার আগে পড়বে তার কবলে। এই ভাবেই ধীরে ধীরে একে একে আমাদের পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, ইউরেনাস, প্লুটোও কবলিত হবে সূর্যের। অনন্তকাল ধরে যে সূর্য ছিল রক্ষক, সেদিন তার হাতেই ধ্বংস হবে নবগ্রহমণ্ডলী।

তারপর মহাজাগতিক এক মহাভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে সূর্যের অস্তিত্ব। এমনি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই চন্দ্রশেখর গড়ে তুললেন সুপারনোভা তারা তত্ত্ব। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা সৌর পদার্থবিদদের আন্তর্জাতিকমহলে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিল তার।

মাত্র ২৭ বছর বয়সেই এই স্বীকৃতি লাভ করলেন চন্দ্রশেখর। কেমব্রিজে অবস্থানকালেই চন্দ্রশেখর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ারকিস মানমন্দির থেকে সুপারনোভা সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ পেলেন। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মানমন্দিরের কর্ণধার ও বিশ্রুত বিজ্ঞানী ডক্টর অটো স্ট্রভে। স্ট্রভে এমন এক পরিবারের মানুষ সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৌরবিজ্ঞানী মহলে যার পরিচয় সৌরবিজ্ঞানী পরিবার নামে প্রসিদ্ধ।

স্ট্রভের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ প্রত্যেকেই ছিলেন প্রথিতযশা সৌরবিজ্ঞানী। অটো স্ট্রভে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর গবেষণায় তার বাপ ঠাকুর্দার কৃতিত্বকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যপদ লাভের পর স্টুভে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এখানে সমবেত করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন। অনুরূপ ভুমিকা পালন করতে আমাদের দেশেও দেখেছি একজন অমিত প্রতিভাধর শিক্ষাবিদ মনীষীকে।

তিনি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির স্বার্থে তিনি ভারতের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিভাবান বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের টেনে নিয়ে এসেছিলেন এখানে। তার দেওয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে বহাল হয়েই জগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন রামন, কৃষ্ণান প্রমুখের মত আরও অনেক প্রতিভা।

ক্ষণজন্মা আশুতোষের দূরদৃষ্টি এমনি করেই আবিষ্কার করেছে ভবিষ্যৎ কালের কত মহাবিজ্ঞানীকে। উন্মোচন করে দিয়েছেন তাদের আত্মপ্রকাশের পথ। ঠিক একই ভাবে স্ট্রভে আবিষ্কার করেছিলেন চন্দ্রশেখরকে। পাঠিয়েছিলেন বক্তৃতার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি। চন্দ্রশেখর এলেন ইয়ারকিস মানমন্দিরে। তাঁর সুপারনোভা সম্পর্কিত বক্তৃতা শুনে অভিভূত হলেন স্ট্রভে। একই রীতিতে তিনিও ভাল মাইনের উচ্চপদে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনে নিলেন চন্দ্রশেখরকে।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর বিবাহ জীবন ও পরিবার: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Marriage Life And Family

এর কিছুদিন পরেই মাদ্রাজে এলেন চন্দ্রশেখর। ললিতা তার পথ চেয়েই বসেছিলেন। তাঁকে জীবনসঙ্গিনী করে চন্দ্রশেখর আবার ফিরে গেলেন বিদেশের কর্মক্ষেত্রে।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর কর্ম জীবন: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Work Life

যথারীতি বসে গেলেন গবেষণার টেবিলে মহাকাশের নাক্ষত্রিক ক্রিয়াকর্মের হিসেব কষাতে। নক্ষত্রের মৃত্যুদশার পর থেকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন তিনি। লক্ষ্য করলেন জ্বালানি নিঃশেষ হবার পরে নক্ষত্রের মধ্যে যে সংকোচন ক্রিয়া অর্থাৎ শীতল হওয়ার ক্রিয়া ঘটতে থাকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থা পর্যন্ত গিয়ে তার বেগ মন্দীভূত হয়।

অবশ্য নক্ষত্রের সঙ্কোচনের ভর সূর্যের ভরের ১.৪৪ গুণ কম হলেই এই অবস্থা সম্ভব হয়ে ওঠে। নক্ষত্রের এই অবস্থাকে বলে হোয়াইট ভোয়ার্ফ স্টেজ বা শুভ্র বামন দশা। যখন নক্ষত্রের সঙ্কুচিত ভর সূর্যের ১.৪৪ গুণের বেশি হয় তখনই ঘটে বিপর্যয়। প্রচন্ড বিস্ফোরণে আলোর অস্বাভাবিক বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চিরকালের মত নক্ষত্র হারিয়ে যায় মহাকাশে। বিলীনকালের প্রাক মুহূর্তে আলোর যে প্রদীপ্ত অবস্থাটি তারই নাম হল সুপারনোভা (supernova).

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর রচনা: Written by Subrahmanyan Chandrasekhar

সূর্যের যে ১.৪৪ গুণ ভরের সীমারেখা এই আবিষ্কারই চন্দ্রশেখরের সমূহ আবিষ্কারের মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত। তার নামানুসারেই চন্দ্রশেখরের সীমা বা Chandra Sekhar’s Limit নামকরণ করা হয়েছে সূর্যের ১.৪৪ গুণ ভরের সীমাকে। ১৯৩৯ খ্রিঃ চন্দ্রশেখরের গ্রন্থ An Introduction to the study of Steller Structure প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের অকুন্ঠ প্রশংসা ও সমাদর লাভ করে এই গ্রন্থ।

বিশ্বের মানুষ পরিচিত হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় চন্দ্রশেখরের অবদানের সঙ্গে। চন্দ্রশেখরের আর একটি অবিস্মরণীয় আবিষ্কার কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্ব বা ব্ল্যাক হোলস। নক্ষত্র বা সৌরপদার্থরা সঙ্কুচিত বা শীতল হতে হতে অতি কঠিন ও অবিশ্বাস্য ওজনের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অবস্থা লাভ করে। এই অবস্থান্তরের প্রকৃতি কেমন ? সেই সন্ধানে বসেই গাণিতিক পথে এক অভাবনীয় তত্ত্বের সন্ধান পেয়ে যান চন্দ্রশেখর। তার নাম দিলেন ব্ল্যাক হোলস।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর পুরস্কার ও সম্মান: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Awards And Honors

তিনি দেখালেন যে সাধারণ চামচে সংকুলান হয় এমন পদার্থ প্রচন্ড সঙ্কুচিত অবস্থায় কয়েক টন পর্যন্ত ওজন লাভ করতে পারে। এই ব্ল্যাকহোলসের ওপরে লেখা চন্দ্রশেখরের বই Mathematical Theory of Black Holes প্রকাশিত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। ১৯৮৩ খ্রিঃ। এই বছরেই পদার্থ বিদ্যায় অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে উইলিয়াম ফাউলারের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।

নোবেল প্রাপ্তির আগেই তার অবদানের জন্য চন্দ্রশেখর বহু সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় সৌরপদার্থবিদ্যা বা Theoretical Physics বিভাগের প্রধান অধ্যাপকের পদ লাভ করেছেন। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স জার্নাল হল আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছেন চন্দ্রশেখর।

১৯৫২ খ্রিঃ পেয়েছেন ব্রুস স্বর্ণপদক; বিখ্যাত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি প্রদত্ত স্বর্ণপদক, ১৯৫৭ খ্রিঃ আমেরিকান আকাদেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স – এর রামফোর্ড পদক। লন্ডনের রয়াল সোসাইটির ফেলো হয়েছেন ১৯৬২ খ্রিঃ। এছাড়া কর্মজীবনে যে পেয়েছেন উচ্চপদ ও প্রতিষ্ঠা তা বলাইবাহুল্য। চন্দ্রশেখরের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইয়ারকিস মানমন্দিরে রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে ১৯৩৭ খ্রিঃ।

এখানে স্ট্রভে ছিলেন তার গবেষণার প্রধান প্রেরণাদাতা। তারই উদ্যোগে এবং স্বকীয় গবেষণা প্রতিভার যোগ্যতাবলে তিনি ক্রমে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের পর চন্দ্রশেখর নানা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনার কাজে হাত দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল Principles of Stellar Dynamics (১৯৪২), Rediative Transfer (১৯৫০), Hydrodynamic and Hydramagnetic stability (১৯৬২), Ellipsoidal figure of Comilibrium (১৯৬৯) ইত্যাদি।

নক্ষত্রের আবহাওয়া, নক্ষত্রের ভর ও নক্ষত্রের গতি সম্পর্কে চন্দ্রশেখরের গবেষণা পদার্থবিজ্ঞানে সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেশ বিদেশের বহু গবেষক তাঁর অনুসরণে গবেষণার কাজে ব্রতী হয়েছেন। এখানেই চন্দ্রশেখরের কাজের সার্থকতা। আকাশের নীল রং ও তরল ভরের ঘূর্ণন সম্পর্কে চন্দ্রশেখরের গবেষণাও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তার অধ্যাপনার খ্যাতিও সুবিস্তৃত।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এর মৃত্যু: Subrahmanyan Chandrasekhar’s Death

১৯৯৫ খ্রিঃ ২১ আগস্ট বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর পরলোক গমন করেন।

Leave a Comment