নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি কাকে বলে? নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

Rate this post

নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি কাকে বলে? নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি: পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 75-150 সেমি এবং বার্ষিক গড় উষ্ণতা 20° সেন্টিগ্রেড, সেই সমস্ত অঞ্চলে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে; তাকে নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি বলে।

নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির অবস্থান

অবস্থান অনুসারে নাতিশীতোষ্ণ বনভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-

ক) ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্য, খ) নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্য ও গ) সরলবর্গীয় অরণ্য। তাই নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির অবস্থান বর্ণনা করতে হলে একযোগে উপরিলিখিত তিনটি বনভূমির অবস্থান বর্ণনা করা প্রয়োজন।

ক)ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমির অবস্থান: উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে 30-40° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমি অবস্থান করছে। প্রধানত উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার মধ্য চিলি উপকূল, ইউরোপের ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী স্পেন, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া, গ্রীস এবং এশিয়ার সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি দেশের ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই বনভূমি দেখা যায়।

খ)নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র বনভূমির অবস্থান: উভয় গোলার্ধের 30-50° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে মধ্য অক্ষাংশীয় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে এই বনভূমি অবস্থান করছে। প্রধানত দক্ষিণ ও পূর্ব চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিন ব্রাজিল, দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে এই বনভূমি দেখা যায়।

গ)সরলবর্গীয় বনভূমির অবস্থান: প্রধানত উত্তর গোলার্ধে 50-70° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অংশে উচ্চ অক্ষাংশীয় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে সরলবর্গীয় বনভূমি অবস্থান করছে। দক্ষিণ গোলার্ধে 50-70° অক্ষাংশের মধ্যে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ বেশি বলে এই বনভূমির পরিমাণ খুব কম দেখা যায়। প্রধানত উত্তর আমেরিকার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং এশিয়ার জাপানের উত্তর অংশে, উত্তর চীনে এবং ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে এই বনভূমি দেখা যায়।

নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির বৈশিষ্ট্য

নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি বলতে যেহেতু আমরা একসাথে ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমি, নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র বনভূমি ও সরলবর্গীয় বনভূমিকে বুঝি, তাই নাতিশীতোষ্ণ বনভূমির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে হলে আমাদের একযোগে উপরিলিখিত তিনটি বনভূমিরই বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা প্রয়োজন। নিম্নে ওই তিনটি বনভূমির বৈশিষ্ট্য পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো-

ক) ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমির বৈশিষ্ট্য

১)ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্যের অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত স্থানগুলিতে চিরহরিৎ এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প বৃষ্টিপাত যুক্ত স্থানগুলিতে গুল্ম ও ঝোপঝাড় জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়।

২)জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্যের উদ্ভিদের মূলগুলি মাটির খুব গভীরে প্রবেশ করে।

৩)গ্রীষ্মকালে যাতে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে না যায়, তার জন্য ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্যের উদ্ভিদের পাতা পুরু, ডালে রেশমের মত কেশ এবং পাতায় মোম জাতীয় পদার্থের আস্তরণ থাকে।

৪)ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্যে ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির বৃক্ষগুলি মোটামুটি ব্যবধানে জন্মায় অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমি অনেক হালকা ও উন্মুক্ত হয়।

৫)শুষ্ক গ্রীষ্মকালে বীজগুলি যাতে শুকিয়ে না যায় তার জন্য ভূমধ্যসাগরীয় অরন্যের উদ্ভিদের ফলগুলি রসালো হয়।

৬)জল সংরক্ষণের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় অরণ্যের অধিকাংশ উদ্ভিদের পাতা ও কান্ড কাঁটাযুক্ত হয়।

খ)নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের বৈশিষ্ট্য

১)এই অরণ্যের উদ্ভিদগুলি প্রধানত পর্ণমোচী জাতীয় অর্থাৎ উদ্ভিদগুলি বছরের একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বিশেষত শীতকালে পাতা ঝরিয়ে দেয়।

২) এই অরণ্যে পর্ণমতী শ্রেণীর উদ্ভিদ যেমন দেখা যায়, তেমনি অপেক্ষাকৃত অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে চিরহরিৎ বৃক্ষও দেখা যায়। এছাড়া এখানকার অপেক্ষাকৃত উচ্চ অংশে সরলবর্গীয় বৃক্ষ জন্মায়। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ একসাথে জন্মায় বলে একে মিশ্র অরণ্য বলে।

৩)এই বনভূমির গাছগুলির পাতা বেশ বড় ও পাতলা এবং কাণ্ড শক্ত ও বাকল পুরু হয়।

৪)এই বনভূমির গাছগুলি একে অপরের থেকে দূরে দূরে অবস্থান করে বলে এই বনভূমি তেমন গভীর ও ঘন নয়।

৫)এই বনভূমিতে একই প্রজাতির উদ্ভিদদের পাশাপাশি অবস্থান করতে দেখা যায়।

গ) সরলবর্গীয় অরণ্যের বৈশিষ্ট্য

১)সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে বছরে প্রায় 8-9 মাস তুষারপাত হয় বলে গাছের ওপর যাতে তুষার জমতে না পারে সেই জন্য গাছগুলির নিচের দিক প্রশস্ত ও ওপরের দিকে সরু (অনেকটা মন্দিরের চূড়ার মত) হয় এবং এদের পাতাগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি হয়।

২)এই অরণ্যের গাছগুলিতে ডালপালা খুব কম থাকে এবং গাছের কান্ডগুলি সোজা উপরের দিকে উঠে যায়।

৩)দীর্ঘস্থায়ী শীতকালে জমাট বাঁধা বরফের স্তুপ থেকে গাছগুলি সহজে জল সংগ্রহ করতে পারে না। তাই অতি কষ্টে সংগৃহীত জলের বাষ্পমোচন রোধ করার জন্য এখানকার গাছগুলোর পাতা ছোট, সরু ও পুরু হয়।

৪)এই অরণ্যের ভূমিভাগ বছরের প্রায় 8-9 মাস বরফাবৃত থাকে বলে অরন্যের তলদেশে কোনরকম ঝোপঝাড় বা লতাগুল্ম জন্মায় না। তাই এই অরণ্যের তলদেশ সর্বদা পরিষ্কার থাকে।

৫)সরলবর্গীয় অরণ্যে একই প্রজাতির বৃক্ষদের মাইলের পর মাইল অঞ্চল জুড়ে পাশাপাশি অবস্থান করতে দেখা যায়।

৬)এই অরণ্যের অধিকাংশ বৃক্ষের কাঠ খুবই নরম ও হালকা হয়।

৭)সরলবর্গীয় অরণ্যের গাছগুলি নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্যের গাছগুলির তুলনায় ফাঁকা ফাঁকা অবস্থান করে। এক কথায় এই বনভূমি মাঝারি ধরনের ঘন হয়।

Leave a Comment