ভারতের উত্তরের বৃহৎ সমভূমি অঞ্চল: ভারতের উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিনে উপদ্বীপীয় মালভূমির মধ্যবর্তী অংশে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে ভারতের উত্তরের বৃহৎ সমভূমি অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। যা সিন্ধু গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র সমভূমি নামেও পরিচিত। এই সমভূমির আয়তন প্রায় 7.8 লক্ষ বর্গ কিমি। উত্তরের সমভূমি অঞ্চল পূর্ব পশ্চিমে প্রায় 2500 কিমি ও উত্তর দক্ষিণে প্রায় 80-500 কিমি বিস্তৃত।
ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য – সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 300 মিটারের কম উচ্চতা বিশিষ্ট এই বৃহৎ সমভূমি অঞ্চল টি পশ্চিম থেকে পূর্বে ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে। ভূমিরূপবিদরা উত্তর ভারতের বৃহৎ সমভূমি অঞ্চলকে একটি নিরবিচ্ছিন্ন বৈচিত্রহীন সমতল ভূমি হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও এই সমভূমির নিজস্ব কিছু ভূমিরূপ গত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ভূ প্রকৃতি ও মৃত্তিকার গঠন প্রণালীর উপর ভিত্তি করে ভারতীয় বৃহৎ সমভূমির নিম্নলিখিত ভূমিরূপ গত বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়। যথা
ক) ভাবর – শিবালিক হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত 8-16 কিলোমিটার চওড়া ঈষৎ ঢেউ খেলানো সমতল অংশটি ভাবর নামে পরিচিত। যা সিন্ধু থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত রয়েছে। হিমালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া নদীবাহিত পদার্থ গুলি হিমালয়ের পাদদেশে পলোল ব্যজনী রূপে সঞ্চিত হয় এবং পরবর্তীকালে সেই পলোল ব্যজনী গুলি একত্রিত হয়ে ভারতের বৃহত্তম সমভূমির উত্তর অংশ গঠন করেছে, যা ভাবর সমভূমি নামে পরিচিত। বৃহৎ আকৃতির নুড়ি, পাথর ও বালি দ্বারা গঠিত বলে ভাবর সমভূমি অঞ্চল টি তে কৃষি কাজ করা সম্ভব হয়না কিন্তু এই অংশে বড় বড় বৃক্ষের বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে।
খ) তরাই – ভাবর অঞ্চলের দক্ষিণে প্রায় সমান্তরালে অবস্থিত 15 থেকে 30 কিমি প্রশস্থ বিশিষ্ট জলাভূমি ময় অঞ্চলকে তরাই বলে। মূলত ভাবর অঞ্চলে অবলুপ্ত হওয়া নদী গুলির এই তরাই অঞ্চলে পুনাবির্ভাব ঘটে বলে নদী গুলির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই কর্দমাক্ত জলাভূমি গুলির সৃষ্টি হয়েছে, যা সমগ্র তরাই অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। পশ্চিম ভারতের তুলনায় পূর্ব ভারতে এই তরাই অঞ্চলের বিস্তার বেশি লক্ষ্য করা যায়, কারণ পূর্ব ভারতে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়ে থাকে। তরাই অঞ্চল ঘন বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত অবস্থায় রয়েছে।
গ) ভাঙ্গর – নদীর প্লাবনভূমি থেকে উচ্চ অংশে অবস্থিত প্রাচীন পলি দ্বারা গঠিত সমভূমি অঞ্চল গুলি ভাঙ্গর নামে পরিচিত। নদীর এই অংশে বন্যার জল প্রবেশ করতে পারে না বলে নতুন পলির সঞ্চয় ঘটে না।
ঘ) খাদার – নদীর প্লাবনভূমি অঞ্চলে প্রতি বছর নবীন পলির সঞ্চয়ের ফলে যে নিচু সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়েছে, তাকে খাদার বলে।
ঙ) রেহ বা কলার – উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানার শুষ্ক অঞ্চলে অধিক লবনতা যুক্ত যে পতিত ভূমি দেখা যায়, তাকে রেহ বা কলার বলে।
চ) ভুর – ভারতের বৃহৎ সমভূমির কোন কোন অঞ্চলে মাঝে মধ্যে বায়ু বাহিত বালির সঞ্চয়ের ফলে অনুচ্চ টিলার আকারে যে বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয়, তাদের ভুর বলে।
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ভারতের উত্তরের বৃহৎ সমভূমি কে চারটি প্রধান মাঝারি অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
1) রাজস্থান সমভূমি
2) পাঞ্জাব সমভূমি
3) গাঙ্গেয় সমভূমি
4) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি
1) রাজস্থান সমভূমি – ভারতের বৃহৎ সমভূমির সর্বাধিক পশ্চিমাংশের নাম রাজস্থান সমভূমি। যা আরাবল্লি পর্বতের পশ্চিম দিকে রাজস্থানের থর মরুভূমি ও পার্শ্ববর্তী উষ্ণ শুষ্ক অঞ্চল নিয়ে প্রায় 17500 বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই সমভূমি অঞ্চলটি সমুদ্রের পশ্চাৎ সরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। রাজস্থান সমভূমির বালুকাময় পশ্চিমাংশ টি বাগার নামে পরিচিত। এই সমভূমির পূর্বাংশ টি আরাবল্লি থেকে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে উৎপন্ন হওয়ায় খুব উর্বর এবং এই অংশ টির নাম রোহি।
2) পাঞ্জাব সমভূমি – রাজস্থান সমভূমির উত্তর – পূর্ব অংশে অবস্থিত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বিশাল অঞ্চলে শতুদ্রু, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা ও বিপাশা নদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে যে সমভূমির বিকাশ ঘটেছে, তাকে পাঞ্জাব সমভূমি বলে। পাঁচ টি নদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে গঠিত বলে একে The land of five rivers বলে। পাঞ্জাব সমভূমির আয়তন প্রায় 95 হাজার বর্গ কিমি। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃতি প্রায় 640 কিমি ও পূর্ব পশ্চিমে প্রায় 300 কিমি দীর্ঘ। গড় উচ্চতা প্রায় 200-250 কিমি। পাঞ্জাব সমভূমি অঞ্চলটি মূলত পাঁচ টি নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলের মিলিত রূপ। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এই দোয়াব গুলি হল –
i. বিপাশা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী বিস্ত জলন্ধর দোয়াব
ii. বিপাশা ও ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী বারি দোয়াব
iii. ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদীর মধ্যবর্তী রেচনা দোয়াব
iv. চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদীর মধ্যবর্তী চাজ দোয়াব
v. বিতস্তা ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী সিন্ধ সাগর দোয়াব
নব গঠিত খাদা র প্লাবন ভূমি গুলি পাঞ্জাব সমভূমি অঞ্চলে স্থানীয় ভাষায় ধায়া নামে পরিচিত।
হিমালয় থেকে বাহিত একাধিক ছোটো ছোটো নদীর দ্বারা ক্ষয় প্রাপ্ত পাঞ্জাব সমভূমির উত্তরের অংশ চোস নামে পরিচিত।
3) গাঙ্গেয় সমভূমি – উত্তর ভারতের বৃহৎ সমভূমির বৃহৎ অংশ টি হল গাঙ্গেয় সমভূমি। যা ভারতের দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় 3.75 লক্ষ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এই সমভূমি অঞ্চল টি মূলত গঙ্গা ও তার অসংখ্য শাখা ও উপনদী র বাহিত পলির সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট বলে, একে গাঙ্গেয় সমভূমি বলা হয়ে থাকে। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল কে ভূমিরূপ গত পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে।
A) উচ্চ গাঙ্গেয় সমভূমি – গাঙ্গেয় সমভূমির এই অংশটি উত্তরে শিবালিক এর পাদদেশ থেকে দক্ষিনে উপদ্বীপীয় মালভূমি উত্তর সীমানা, পশ্চিমে যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত। উচ্চ গাঙ্গেয় সমভূমির বিস্তার প্রায় 1.49 লক্ষ বর্গ কিমি।
B) মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমি – মধ্য ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ ও বিহার জুড়ে বিস্তৃত গাঙ্গেয় সমভূমির এই অংশের বিস্তৃতি প্রায় 1.44 বর্গ কিমি।
C) নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমি – গাঙ্গেয় সমভূমির নিম্ন অংশ টি পূর্বে পাটনা ও দার্জিলিং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে গঙ্গা নদীর মোহনা বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশের আয়তন প্রায় 81 হাজার বর্গ কিলোমিটার।
4) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি – ব্রহ্মপুত্র ও তার উপ নদীবাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে এই সমভূমি গঠিত হয়েছে বলে কে ব্রহ্মপুত্র সমভূমি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বলা হয়। আবার এই সমভূমির বেশিরভাগ অংশ আসামে রয়েছে বলে একে আসাম সমভূমি ও বলা হয়। এই সমভূমির তিনদিক বিভিন্ন উচ্চতার পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। ব্রহ্মপুত্র সমভূমির আয়তন প্রায় 56 হাজার বর্গ কিমি।