আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া

Rate this post

আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া: সাধারনত আবহবিকার হল আবহাওয়া দ্বারা ভূপৃষ্ঠের বিকার সাধন। আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, যেমন – উষ্ণতা, আর্দ্রতা প্রভৃতির প্রভাবে ভূত্বকের বিকার ঘটে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের শিলাসমূহ আবহাওয়ার প্রভাবে ক্রমাগত শিথিল হতে হতে ছোট ছোট শিলাখন্ডে পরিনত হয় এবং সেখানেই শিলাস্তরের ওপর স্তরায়নের মতন অবস্থান করে। আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট চূর্নবিচূর্ন পদার্থ মূল শিলার ওপরেই পড়ে থাকে অর্থাৎ এগুলোর কোন স্থানান্তর ঘটে না বলে আবহবিকারকে বিচূর্নীভবনও বলা হয়। 

আবহবিকার, ক্ষয়ীভবন ও নগ্নীভবনের সম্পর্ক 

আবহবিকারঃ আবহবিকার হল একটি স্থৈতিক প্রক্রিয়া অর্থাৎ আবহবিকার বলতে বোঝায় শিলাস্তরের শিলাখন্ড ও শিলাচূর্নের পরিনত এবং তাদের সেখানেই অর্থাৎ মূলশিলার ওপরেই অবস্থান।

ক্ষয়ীভবনঃ আবহবিকারের দ্বারা সৃষ্ট শিলাখন্ড ও শিলাচূর্ন নদী, বায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা অপসারিত হলে মূলশিলার উচ্চতা হ্রাস পাওয়ার ঘটনাকে ক্ষয়ীভবন বলে। 

নগ্নীভবনঃ আবহবিকার ও ক্ষয়ীভবনের ফলে ভূপৃষ্ঠের নগ্নীভবন ঘটে। নগ্নীভবনের ফলে নীচের শিলাস্তর আবহাওয়ায় উন্মুক্ত হয় এবং তখন আবার সেই উন্মুক্ত শিলাস্তরে আবহবিকার ঘটতে থাকে। 
উদাহরন হিসাবে বলা যায় – বায়ুপ্রবাহের ফলে ভূপৃষ্ঠের শিলাসমূহ চূর্নবিচূর্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কালক্রমে অপসারিত হয়। সুতরাং বায়ু প্রবাহের কাজ একধারে আবহবিকার ও ক্ষয়ীভবনের অন্তর্গত এবং এই দুটি প্রক্রিয়ার সম্মিলিত ফল হল নগ্নীভবন।  

আবহবিকারের শ্রেণীবিভাগ

আবহবিকার সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়, যেমন – ক) যান্ত্রিক আবহবিকার ও খ) রাসায়নিক আবহবিকার। 

যান্ত্রিক আবহবিকার কাকে বলে?

তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, হিমবাহ প্রকৃতির প্রভাবে স্বাভাবিকভাবে বা প্রাকৃতিক উপায় শিলা সমূহ ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়াকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে। এ প্রক্রিয়ার ফলে শিলা বা শিলার মধ্যবর্তী খনিজের কেবল ভৌত পরিবর্তন হয়।

যান্ত্রিক আবহবিকার এর প্রক্রিয়া সমূহ: ভূবিজ্ঞানী পেরি রাইশ এর মতে প্রধানত পাঁচটি প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক আবহবিকার সম্পন্ন হয়। এগুলি হল –
1. চাপ হ্রাস জনিত আবহবিকার
2. তাপ পরিবর্তনজনিত আবহবিকার
3. কেলাস জনিত আবহবিকার
4. জৈব কর্ম বৃত প্রক্রিয়া
5. কলয়েড উৎপাটন 

1. শিলার চাপ হ্রাস জনিত আবহবিকার 

কোন শিলাস্তর যদি প্রাথমিকভাবে ওপরে শিলাস্তরে চাপের মধ্যে থাকে এবং পরে যদি ওপরে শিলা স্তর ক্ষয়ের মাধ্যমে অপসারিত হয় তখন চাপ হ্রাসর কারণে শিলাস্তর ভেঙে যায়। চাপ হ্রাসের কারণে মূলত সিটিং ও স্প্যালিং দেখা যায়।

A. শিটিং – কোন শিলা ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল ফাটলের মাধ্যমে পাতলা পাতে বা স্তরে ভাগ হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে সিটিং বলা হয়। গিলবার্ট এর মতে উপরের শিলার ক্ষয় জনিত চাপের অপসারণের কারণেই মূলত গ্রানাইট শিলার ওপরের স্তরের প্রসারণ হয় এবং এর ফলে পাত গঠিত হয়।

B. স্প্যালিং – উপরে শিলাস্তর দুর্বল হলে চাপ হ্রাসের কারণে বিস্ফোরণসহ শিটিং হতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপরে শিলাস্তর অপসারিত হলেও সিটিং নাও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে শিলাস্তর কিছুটা বিশৃংখল ভাবে ছোট ছোট পাতলা খন্ডে আলাদা হয়ে যায় একে ই স্প্যালিং বলে।

2. তাপ পরিবর্তনজনিত আবহবিকার

উষ্ণ মরু অঞ্চলে পরিবর্তনজনিত আবহবিকার প্রক্রিয়ার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সারা বছর ধরে উষ্ণতা তারতম্যে শিলাস্তরের সংকোচন-প্রসারণ চলতে থাকে। যেমন – দিন-রাত্রির বিভিন্ন সময়ে এবং ঋতু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ঋতুতে যে তাপে তারতম্য হয় তারফলে ক্রমান্বয়ে সংকোচন-প্রসারণের ফলে ছিল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। নানাভাবে এই প্রক্রিয়া ঘটে থাকে।

A. প্রস্তর চাঁই বিচ্ছিন্নকরণ – শিলা তাপের কুপরিবাহী বলে উষ্ণ অঞ্চলের সূর্যতাপে শিলার উপরের স্তর যতটা উত্তপ্ত  হয় নিচের স্তর ততটা উত্তপ্ত হয় না। এজন্য অসমভাবে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলার মধ্যে প্রবল অভ্যন্তরীণ পীরণের সৃষ্টি হয়। এক সময় বিভিন্ন ফাটলের মধ্যবর্তী শিলা রাশি চাঁই এর আকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একে প্রস্তর চাঁই বিচ্ছিন্নকরণ বলে।

B. ক্ষুদ্র কণা বিশরণ – বিভিন্ন খনিজের সংমিশ্রণে গঠিত ছিল গুলি খুব গরম বা ঠাণ্ সমান ভাবে প্রসারিত বা সংকুচিত হয় না। এর ফলে শিলার মধ্যে অসমভাবে টানের সৃষ্টি হয়। এক সময় বিভিন্ন খনিজের সীমা বরাবর প্রচন্ড শব্দে শিলাগুলো চুরমার হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই পদ্ধতিকে ক্ষুদ্র কণা বিশরন বলে।

C. শল্কমোচন – শল্কমোচন শব্দের অর্থ হলো শিলার ওপরের ছাল বা খোলস উঠে আসা। শিলা তাপের কুপরিবাহী অর্থাৎ শিলার উপরিভাগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যত দ্রুত ও যতটা উত্তপ্ত হয় বা শীতল হয়, শিলার ভিতরের অংশ তত দ্রুত উত্তপ্ত ও শীতল হয় না। ফলে শিলার বাইরের অংশ ও ভিতরের অংশের মধ্যে উষ্ণতা তারতম্য রয়ে যায়। ফলে ওপরের স্তরটি পিয়াঁজ এর খোসার মতো পরপর খুলে যায়। গ্রানাইট জাতীয় শিলা এরূপ আবহবিকার বেশি দেখা যায়। 

D. বোল্ডার ভাঙ্গন – অনেক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত শিলার মধ্যে বড় বড় বোল্ডার বা পাথরের খন্ড অবস্থান করে। তাপের প্রভাবে এরূপ শিলার ওপরি ভাগের অংশ প্রসারিত হলেও ভূমি দ্বারা আবদ্ধ অংশ তেমন প্রসারিত হয় না। একসময় অসমান পিরন এর ফলে বোল্ডার সহ শিলা ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই পদ্ধতিকে বোল্ডার ভাঙ্গন বলে। 

3. কেলাস জনিত আবহবিকার

কেলাস গঠন এর সময় সাধারনত পদার্থের আয়তন বাড়ে এবং এর ফলে শিলার যে চাপ পড়ে, তাতে শিলা খণ্ডিত হয়। জল জমাট বেঁধে বরফে এবং লবণ জমাট বেঁধে দানাবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াকে কেলাস গঠন বলা হয়।

A. তুষারের কেলাস গঠন প্রক্রিয়া – উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বা শীতল জলবায়ু অঞ্চলে বৃষ্টির জল বা তুষার গলা জল শিলাস্তরের বিভিন্ন ফাটলে সঞ্চিত হয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বরফে পরিণত হয়। জল জমে বরফে পরিণত হলে আয়তনে 9% বৃদ্ধি পায়। ফলে শিলাস্তরের প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয় এবং তা কোন যুক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে ভেঙে যায়। তুষারের ক্রিয়ায় এই রূপ আবহবিকার কে তুষার খন্ডীকরণ বলে।

B. লবনের কেলাস গঠন প্রক্রিয়া–  শুষ্ক ও  উপশুষ্ক  অঞ্চলে এবং উপকূল অঞ্চলে ভৌম জলে দ্রাব্য লবণ কৌশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে এবং বাষ্পীয় হয়ে লবণের স্ফটিক গঠন করে। শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যে এই লবণের স্ফটিক সঞ্চিত হয়ে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করে এবং একসময় শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। 

4.  জৈব কর্মবৃত প্রক্রিয়া – জৈব কর্মরত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত আবহবিকার কে সাধারণভাবে জৈব আবহবিকার বলে। বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ, ক্ষুদ্র জীবাণু ও মানুষ যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আবহবিকারে সাহায্য করে। যেমন – কেঁচো, উঁইপোকা, ইঁদুর, খরগোশ প্রভৃতি প্রাণী মাটিতে গর্ত করে। উদ্ভিদের শিখর শিলায় প্রবেশ করে শিলায় ফাটল সৃষ্টি করে।

E. কলয়েড উৎপাদন প্রক্রিয়া – মাটির খনিজ ও অজৈব পদার্থ অতি সূক্ষাতিসূক্ষ অংশে বিভক্ত হয়ে যে আঠালো পদার্থের সৃষ্টি করে তাকে কলয়েড বলে। মাটি শুকিয়ে গেলে কলয়েড ধর্মের প্রভাবে শিলাস্তরের কিছু অংশ উৎপাটিত হয়ে যায়। এর ফলে যে শিলা বিকার ঘটে, কে কলয়েড উৎপাটন প্রক্রিয়া বলে।

স্লেকিং – ক্রমান্বয়ে সিক্ত এবং শুষ্ক তার ফলে শিলার বা খনিজের যে পরিবর্তন হয়, তাকে স্লেকিং বলে। বেলে পাথর, সিল্ট পাথর ও কাদা পাথর নিয়ে প্রথমে একদিন ভিজিয়ে পরে এতদিন ধরে শুষ্ক করা হলে দেখা যাবে এই শিলিগুড়ি পরিবর্তিত হলেও অন্যান্য সূক্ষ্ম দানার শিলা গুলি বেশি মাত্রায় খণ্ডিত হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে সিক্ত ও শুষ্ক করা হলে শিলার খন্ডিত হওয়ার প্রবণতা আরো বাড়ে। 

রাসায়নিক আবহবিকার কাকে বলে?

বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদান ( যেমন – কার্বন ডাই অক্সাইড, অক্সিজেন, জলীয় বাষ্প) এবং উদ্ভিদ ও প্রানীর প্রভাবে শিলাসমূহ যখন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে যায়, তখন তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে। রাসায়নিক আবহবিকারে শিলার মধ্যবর্তী খনিজ গুলি পরিবর্তিত হয়ে গৌন খনিজে পরিনত হয় বলে সহজেই শিলাসমূহ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। 

রাসায়নিক আবহবিকার প্রধানত নিরক্ষীয় উষ্ণ আর্দ্র এবং ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে দেখা যায়। 

রাসায়নিক আবহবিকারের প্রক্রিয়া সমূহ 

1. অক্সিডেশন বা জারন – শিলার খনিজের সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে যে বিয়োজন ঘটায়, তাকে অক্সিডেশন বলে। সাধারণত যে সব শিলা সালফাইড, কার্বনেট ও লৌহ সিলিকেট রূপে অবস্থান করে সে সব শিলার খনিজের ওপর জারন প্রক্রিয়া বিশেষ ভাবে কার্যকরী হয়। এর ফলে লোহার ওপর হলদে ও বাদামী রঙের এক প্রকার নতুন যৌগ পদার্থের সৃষ্টি হয় ও লোহায় সহজে মরচে পড়ে এবং লোহা যুক্ত শিলা খনিজ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। 

2. কার্বনেশন বা অঙ্গারযোজন – বৃষ্টির জলের সাথে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত হয়ে কার্বনিক অ্যাসিডের সৃষ্টি হয়। এই অ্যাসিড শিলার খনিজের সাথে বিক্রিয়া করে শিলাকে বিশ্লিষ্ট করে ক্ষয় ঘটায়। বিশেষ করে যে সব শিলায় ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, লৌহ ইত্যাদি খনিজের পরিমান অধিক থাকে, সেগুলি কার্বনিক অ্যাসিডের সংস্পর্শে অতি সহজে গলে যায়। এই ভাবে বিভিন্ন খনিজের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইডের রাসায়নিক সংযোজন কে কার্বনেশন বা অঙ্গারযোজন বলে। 

3. দ্রবন – সরাসরি জল দ্বারা খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত হয় না বা গলে যায় না। কিন্তু শিলায় অবস্থিত কোন কোন খনিজ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যে তখন সহজেই জলে দ্রবীভূত হয় বা গলে যায়। একেই দ্রবন বলে। বিশেষ করে চুনাপাথর এই প্রকার দ্রবন দেখা যায়। তা ছাড়া ক্যালসাইট, জিপসাম ইত্যাদি জাতীয় খনিজ দ্রব্য জলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গলে যায়। এই কারণে একে দ্রবন বলে। 

4. হাইড্রোলিসিস বা আর্দ্র বিশ্লেষণ – আর্দ্র বিশ্লেষণে জল হাইড্রোজেন ও হাইড্রোক্সিল আয়নে ভেঙে যায় এবং উৎপন্ন হাইড্রোক্সিল আয়ন খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে রাসায়নিক পরিবর্তন সাধন করে, একে হাইড্রোলিসিস বা আর্দ্র বিশ্লেষণ বলে। অর্থক্লেজ ফেল্ডসপার আর্দ্র বিশ্লেষণের ফলে অয়ালুমিনো সিলিসিক ও পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইডে পরিনত হয়। 

5. হাইড্রেশন বা জলযোজন – শিলার মধ্যবর্তী কোন খনিজের সঙ্গে বিশুদ্ধ জল যুক্ত হয়ে যে রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায়, তাকে হাইড্রেশন বলে। এর ফলে শুষ্ক ক্যালসিয়াম সালফেট জিপ্সামে এবং হেমাটাইট লিমোনাইটে পরিনত হয়। 

Leave a Comment