গুরু নানক জীবনী | Guru Nanak Biography in Bengali

Rate this post

গুরু নানক জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Guru Nanak Biography in Bengali. আপনারা যারা গুরু নানক সম্পর্কে জানতে আগ্রহী গুরু নানক এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

গুরু নানক কে ছিলেন? Who is Guru Nanak?

গুরু নানক দেব (এপ্রিল ১৫, ১৪৬৯ – সেপ্টেম্বর ২২, ১৫৩৯) শিখ ধর্মের প্রবক্তা এবং এই ধর্মের প্রথম গুরু। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে তার জন্মোৎসব পালিত হয়। তিনি বহু স্থানে ভ্রমণ করে মানুষের মধ্যে এক ঈশ্বরের মতবাদ প্রচলন করেন। তিনি সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সদাচরণের ওপর নির্ভর করে একটি অনন্য ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করতে সক্ষম হন। শিখ ধর্মে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, পরবর্তী শিখ গুরুদের গুরুপদ লাভের সময় তাদের মধ্যে গুরু নানকের ঐশ্বরিক ক্ষমতা, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও পবিত্রতা প্রবাহিত হয়ে থাকে।

গুরু নানক জীবনী – Guru Nanak Biography in Bengali

নামগুরু নানক
জন্ম15 এপ্রিল 1469
পিতামেহতা কলু
মাতামাতা ত্রিপ্তা
জন্মস্থানরায় ভোয় কি তালবন্দী গ্রাম, দিল্লী সুলতানত [বর্তমানে: নানকানা সাহেব, পাকিস্তান]
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাশিখ ধর্মের প্রবক্তা এবং এই ধর্মের প্রথম গুরু
মৃত্যু22 সেপ্টেম্বর 1539 (বয়স 70)

গুরু নানক এর জন্ম: Guru Nanak’s Birthday

গুরু নানক 15 এপ্রিল 1469 জন্মগ্রহণ করেন।

গুরু নানক এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Guru Nanak’s Parents And Birth Place

শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের জন্ম ১৪৬৯ খ্রিঃ ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোরের নিকটবর্তী তালওয়ান্দি গ্রামে। এই স্থানটি বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত, নাম হয়েছে নানকানা সাহেব। নানকের পিতার নাম মেহেতা কন্যানবাই। সকলে তাঁকে মেহতা কালু নামেই ডাকতো। নানকের মায়ের নাম ত্রিপতা। নানক ছিলেন ধর্মপ্রাণ পিতামাতার একমাত্র পুত্র সন্তান।

গুরু নানক এর শিক্ষাজীবন: Guru Nanak’s Educational Life

ছেলেবেলা থেকেই তিনি একান্তে নির্জনে থাকতে ভালবাসতেন। কী এক ভাবের মধ্যে যেন নিমগ্ন হয়ে থাকতেন। লেখাপড়া কিংবা বাড়ির কাজেকর্মে কোন বিষয়েই তাঁর তেমন আগ্রহ দেখা যেত না। তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন গোপাল পন্ডিত। সব সময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তিনি একদিন নানককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, নানকের ঈশ্বরকথা, ধর্মকথা ছাড়া কিছু শুনতে বা জানতে ভাল লাগে না।

গোপাল পন্ডিত তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, এই শিশু অন্য দশটি সাধারণ শিশুর মত নয়। তিনি তারপর থেকে নানকের সঙ্গে ঈশ্বরীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। নানকের শিশু মনে এই শিক্ষকের স্মৃতি স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার কথা উল্লেখ করতেন। যাইহোক স্কুলে তিন বছর যাতায়াত করে নানক গোপাল পন্ডিতের কাছে মাতৃভাষা শিক্ষা করলেন।

পাঠশালার পড়া শেষ হলে নানককে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ব্রিজনাথ শৰ্মা নামে এক পন্ডিতের টোলে পাঠানো হলো। নানকের আগ্রহ ছিল ধর্ম ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে, স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশুনো তার কাছে অসার বলেই মনে হতো। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ৷ কালু ছেলেকে এবারে সংসারের কাজকর্মের দায়িত্ব দিলেন। গ্রামের পাশেই ছিল বিস্তৃত তৃণভূমি।

নানককে প্রতিদিন সকালে সেখানে বাড়ির গরু ছাগল নিয়ে চরাতে যেতে হয়। একদিন ক্লান্ত হয়ে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই অবসরে তার গরুগুলো পাশের এক ক্ষেতে নেমে ফসল খেতে শুরু করল। ক্ষেতের মালিক দেখতে পেয়ে গরু গুলোকে ধরে নিয়ে গাঁয়ের জমিদারের কাছে নালিশ করল। যথারীতি ডাক পড়ল নানকের। তিনি জমিদারের কাছে গিয়ে বললেন, আমার গরু কোন ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেনি।

জমিদারের লোকজন সেই ক্ষেতের মালিককে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখল নানকের কথা সত্যি। ক্ষেতের ফসলের কোন ক্ষতিই হয়নি। এই ঘটনায় ক্ষেতের মালিক হতভম্ব হয়ে গেল। নানকের গরু ক্ষেতের অর্ধেক ফসল নষ্ট করে ফেলেছে সে নিজের চোখেই দেখে গিয়েছিল। নানকের মধ্যে কোন দৈবশক্তি আছে বিস্মিত হয়ে একথাই সেদিন সে ভেবেছিল। একথা জানাজানি হবার পর গাঁয়ের মানুষরা নানককে সাধু মহাত্মা ভেবে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে আরম্ভ করল। আর একদিন এমনি গরু চরাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি।

সেই সময় কাছাকাছি পথ দিয়ে গাঁয়ের জমিদার রাইবুলার যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন, জঙ্গলের একটি বিষধর সাপ নিদ্রিত নানকের মাথার কাছে ফণা তুলে রোদ আড়াল করে রেখেছে। অভিজ্ঞ রাইবুলার বুঝতে পারলেন এই বালক সাধারণ নয়, নিশ্চয় কোন মহাপুরুষ। এই ঘটনার পর থেকে তিনি নানককে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘর – সংসারের প্রতি নানকের উদাসীনতাও বাড়তে লাগল।

প্রায়ই দেখা যেত তিনি নির্জনে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন। গাঁয়ে কোন সাধু সন্ন্যাসী এলে তিনি তাঁদের কাছে গিয় ঈশ্বরের কথা ধর্ম উপদেশ শুনতে বসতেন। ছেলের উদাসীনভাব দেখে কালু চিন্তায় পড়লেন। ভাবলেন বিয়ে দিয়ে ছেলেকে সংসারী করবেন। কিন্তু তার আগে তো একটা কাজকর্ম দরকার। সেই সময় জমিদারী সেরেস্তায় কাজকর্ম পেতে হলে ফার্সি ভাষা জানতে হতো।

কালু নানককে ফার্সি শেখাবার জন্য এক মৌলবীর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তখন তার বয়স বারো বছর। কিন্তু এখানেও সেই ঈশ্বরের কথা, আর ধর্মের কথা। ফার্সিভাষা শেখাও মাঝপথে ইস্তফা দিতে হল।

গুরু নানক এর কর্ম জীবন: Guru Nanak’s Work Life

জয়রাম নামে নানকের এক ভগ্নীপতি ছিলেন সুলতান দৌলত খাঁ লোদীর দেওয়ান। তার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত উদাসী নানকের কাজকর্মের একটা হিল্লে হল। সুলতান তাঁকে গুদামঘর দেখাশোনার কাজে নিয়োগ করলেন। সময়টা তখন ১৪৮৫ খ্রিঃ। নানকের কাজ ছিল, সারা দিনে গুদামে কত মাল আনা নেওয়া করা হত তার হিসাব রাখা ৷ নানক এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গেই করতে লাগলেন। গরীব দুঃখী মানুষ দেখলে নানকের মন কাতর হয়ে পড়ত।

মাঝে মাঝেই তিনি তাদের গুদাম থেকে চাল ডাল দান করতেন। নিজেও যা মাইনে পেতেন, তার বেশির ভাগটাই গরীব – দুখী মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এদিকে বিষয়কর্মে নানকের মন বসেছে দেখে তার বাবামা একদিন শুভ দিন দেখে নানকের বিয়ে দিলেন। নানকের স্ত্রীর নাম সুলখনি। পরবর্তীকালে নানক শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্মীদাস নামে দুই সন্তানের জনক হন। সংসারের সব কাজকর্মের মধ্যেও নানকের মন সর্বদা ঈশ্বর চিন্তায় ডুবে থাকত ৷

সারাদিনের কাজের শেষে রাতে তিনি নিভৃতে ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন হতেন। ক্রমে তিনি তার অন্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সংসারের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে তাঁকে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। মানুষের কল্যাণের জন্য তাঁকে কাজ করতে হবে; ঈশ্বর তাঁকে সেই কাজের জন্যই পাঠিয়েছেন। এরপর থেকে তিনি সংসারবন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল করে আনতে লাগলেন। একদিন সুলতানের চাকরি ছেড়ে দিলেন। এখন অফুরন্ত অবসর।

সারাদিন ঈশ্বরের নামগান আর ঈশ্বর প্রসঙ্গের মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। নানকের ধার্মিকতায় আকৃষ্ট হয়ে গাঁয়ের লোকজন ধর্মকথা শুনবার জন্য তার কাছে জড়ো হতে লাগল। তিনিও তাদের পরমানন্দে ঈশ্বরের কথা শোনাতেন। তাঁর কাছে জাতিধর্মের কোন বিচার ছিল না। তিনি বলতেন, সকলেই এক পরমাত্মার সন্তান। ধীরে ধীরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। তিনি শিষ্য ও ভক্তদের নিয়ে ভজন গান করতেন।

নিজে লিখতেনও ভজন গান। মর্দানা নামে এক চারণকবি এই সময়ে নানকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার সঙ্গেই থাকতে লাগলেন। তিনি যখন পরিব্রাজনে বের হতেন তখন মর্দানা থাকতেন সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই নানকের শিষ্যসংখ্যা বাড়তে লাগল। তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই তাঁর কথায় আকৃষ্ট হতো আবালবৃদ্ধ সকলে। নানক ছিলেন একেশ্বরবাদী। অপর কোন দেবদেবী তিনি স্বীকার করতেন না। তিনি বলতেন ভক্তি আর গুরুর কৃপাতেই মানুষ ঈশ্বরকে লাভ করতে পারে।

একবার পরিব্রাজনে বেরিয়ে নানক এলেন আমিনাবাদে। সেখানকার দেওয়ান মালিক ভাগো ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী। তার নিপীড়নে ও শোষণে সাধারণ মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে দিন কাটাত। এখানে লালো নামে এক গরীব সূত্রধরের বাড়িতে উঠলেন নানক। লালো ছিলেন তাঁর শিষ্য। মালিক ভাগো সাধুপুরুষ নানকের নাম আগেই শুনেছিলেন। তিনি নানককে আপ্যায়ন করবার জন্য বিরাট ভোজের আয়োজন করে তাকে নিমন্ত্রণ জানালেন। নানক সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন।

এতে মালিক ভাগো ক্রুদ্ধ হলে নানক মালিকের স্বরূপ উদঘাটনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত খাদ্যবস্তু নিয়ে আসতে বললেন। অনেক খরচপত্র করে বিরাট আয়োজন করেছিলেন মালিক ভাগো। তার আদেশে কর্মচারীরা পাত্র ভর্তি করে নানান খাদ্য এনে দিল। নানক একটি রুটি তুলে চাপ দিতেই তা থেকে ঝরে পড়তে লাগল ফোটা ফোটা রক্ত। এরপর তিনি ভক্ত লালোর কাছ থেকে আনা একখানা রুটি বার করে তা চাপ দিতেই ঝরে পড়তে লাগল দুধ। নানক বললেন, তুমি লোভী ও নিষ্ঠুর।

গরীব মানুষের রক্তঝরা ফসল দিয়ে আমার খাবার তৈরি করেছিলে। আর আমার শিষ্য দরিদ্র লালো তার সদ্য পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে আমাকে সেবা করতে চেয়েছে, এই কারণেই তার তৈরি রুটি অতি পবিত্রতা থেকে দুধ ঝরে পড়েছে, আর তোমার রুটি থেকে পড়েছে গরীবমানুষের শরীরের রক্তের ফেঁাটা। এই ঘটনায় নানকের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে এবং নিজের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে ভাগো সকাতরে নানকের করুণা ভিক্ষা করলেন।

নানক তাকে আশীর্বাদ করে বললেন, সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, কারো ওপরে অত্যাচার করো না, সৎ হও, পরিশ্রমী হও, তাহলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করবে। সেই কালে সমাজ ছিল জাতিভেদ প্রথায় কলুষিত। ধর্মের নামে অধর্ম, স্বার্থপরতা, অনাচার প্রবল হয়ে উঠেছিল। এক ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষকে ঘৃণা করত। হিংসা আর দ্বেষ হয়ে উঠেছি। সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের নিত্য সঙ্গী। নানক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সমাজের এই কলুষ দূর করে মানুষে মানুষে গড়ে তুলতে হবে সম্প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক। সমাজের সেই বন্ধনের সূত্র করে তুলতে হবে ধর্মকে।

এরপর দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে নানক দেশে দেশে তার ধর্মমত প্রচার করে বেড়িয়েছেন। মানুষকে সৎ ও ঈশ্বর বিশ্বাসী হবার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলতেন, ধনী দরিদ্র, উঁচু নীচু সব জাতের মানুষই এক পরম পিতার সন্তান। তাঁর চোখে সকলেই সমান। যে মানুষ সৎ ও সরল বিশ্বাসী, সৎপথে জীবন যাপন করে কেবল সেই তার কৃপালাভ করতে পারে। ধর্মের নামে অনাবশ্যক আচার অনুষ্ঠান ও গোঁড়ামির নিন্দা করে তিনি বলতেন, কেবল অন্তরের ভক্তি আর বিশ্বাস দিয়েই ঈশ্বরকে লাভ করা যায় অন্য কিছুতে নয়।

একবার এক দুর্ধর্ষ ডাকাত, তার নাম সজ্জন, সে নানককে দেখতে পেয়ে সমাদর করে বাড়িতে নিয়ে এলো। সজ্জন বাইরে ভালমানুষ সেজে থাকত। অচেনা মানুষ দেখলে আদর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসত, তারপর অনেক রাতে তার সর্বস্ব হরণ করে তাকে খুন করত। নানককেও একইভাবে হত্যা করা ছিল তার উদ্দেশ্য। নানক ডাকাত সজ্জনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাকে পাশে বসিয়ে গান গাইতে লাগলেন। গানটির অর্থ ছিল এরকম, তীর্থক্ষেত্রে থাকে ভদ্র – দর্শন বক ও বাজপাখি। এরা জীবন্ত প্রাণী ধরে খায় ৷ অথচ এদের দেখতে কত সুন্দর। কিন্তু অন্তরে এরা কত নিষ্ঠুর।

গানের মর্মকথা ডাকাত সজ্জনের মর্ম স্পর্শ করল। সে – ও তো ওই নিষ্ঠুর পাখিদের মতই হিংস্র হয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে ! অনুতাপে বেদনায় তার অন্তর কেঁদে ওঠে। সে অকপটে নিজের সমস্ত পাপ স্বীকার করে নানকের শরণ নিল। দয়ালু নানক তাকে উপদেশ দিলেন, এতদিন পাপের পথে যে অর্থ উপার্জন করেছ, তা বিলিয়ে দাও গরীব দুঃখীদের মধ্যে। এবার থেকে সৎভাবে পরিশ্রম কর — আর ঈশ্বরের নাম গান কর। সজ্জন তার যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে নানকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।

পরবর্তীকালে এই সজ্জনই ভারতে সর্বপ্রথম শিখদের গুরুদোয়ারা স্থাপন করেন। ঘুরতে ঘুরতে নানক এলেন সৈয়দপুরে। সেই সময় পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে পরাস্ত করে বাবর সসৈন্যে ভারতে প্রবেশ করেছেন। একের পর এক অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে তার সৈন্যরা। চারদিকে বিশৃঙ্খলা, বাবর সৈন্যদের অত্যাচার আর ধ্বংসের তান্ডব। এই পরিস্থিতির মধ্যেই এগিয়ে চলেছেন নানক আর তাঁর নিত্যসঙ্গী মর্দানা। সৈন্যরা শত্রুপক্ষের চর ভেবে দুজনকে কারাগারে বন্দি করল। নানক নির্বিকার।

তিনি মুক্তপুরুষ, বাইরের মুক্ত পৃথিবী আর বন্দিনিবাস কারাগার তার কাছে কোন তফাৎ নেই। সৈন্যরা নানককে যাঁতায় ডাল ভাঙ্গতে বসিয়ে দিয়েছিল। তিনি ভজনগান করতে করতে কাজ করে চললেন। প্রহরীরা দেখল, নানক কেবল ডাল ঢেলে চলেছেন, যাঁতা আপনা থেকেই ঘুরছে। তারা এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে তখুনি খবর পাঠাল সেনাপতি মীর খানকে। তিনি এসে নানকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন, তারা বড় ভুল করে ফেলেছেন। না জেনে একজন মহাপুরুষকে বন্দি করে রেখেছেন। তখুনি তিনি সসম্মানে মুক্তি দিলেন দুজনকে।

এখানে প্রায় দু’মাসকাল বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল নানককে ৷ মক্কা আর মদিনা হল মুসলমানদের দুই পবিত্র তীর্থস্থান। ঘুরতে ঘুরতে নানক এলেন মক্কায় ৷ এই সময় তার সঙ্গী ছিলেন দুজন মুসলিম সাধক। তাঁরা হলেন পীর সৈয়দ আহমদ হাসান ও পীর জালালুদ্দীন। নানকের সাধন ক্ষমতা দেখে এঁরা দুজনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। একদিন নানক মক্কার দিকে পা দিয়ে পথের পাশে শুয়েছিলেন। কয়েকজন মৌলবী তাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন, তুমি পা সরিয়ে শোও, জান না পশ্চিম দিকে আল্লাহ থাকেন।

নানক হেসে তাদের বললেন, ভাই, যেদিকে আল্লাহ থাকেন না, সেদিকে আমার পা ঘুরিয়ে দাও। মৌলবী কয়জন নানকের পা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু তারা দেখতে পেল, সেই দিকেও মক্কা। তারা বিস্মিত হয়ে দেখল, যেদিকে নানকের পা ঘোরায় সেই দিকেই মক্কা ৷ এই কান্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল মৌলবীরা। নানক তখন বললেন, ভাই আল্লাহ কেবল মক্কাতেই থাকেন না, এই বিশ্বসংসার তাঁরই সৃষ্টি –এর সর্বত্রই তিনি রয়েছেন। যারা অজ্ঞান তারাই পূর্ব – পশ্চিমে ভেদাভেদ করে। মক্কা ও মদিনা পর্যটনের পর নানক পবিত্র প্যালেস্টাইনেও গিয়েছিলেন।

সবধর্মেই যে এক ঈশ্বরের কথাই ব্যক্ত হয়েছে, এই তীর্থপর্যটনের মাধ্যমে নানক তাই তাঁর ভক্ত – শিষ্যদের বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। নানক যখন যেখানে গেছেন, সেখানেই এক ঈশ্বরের কথা প্রচার করেছেন। সদুপদেশ দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরীয় পথের সন্ধান দিয়েছেন। দীর্ঘ কুড়িবছর দেশে দেশে ঘুরেছেন নানক। যখন আবার দেশের পথ ধরলেন, তখন তিনি প্রৌঢ়ত্বে উপনীত। একদিন চলতে চলতে খুবই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। নির্জন এক প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন শিষ্যদের নিয়ে।

একজন শিষ্য গেলেন জল সংগ্রহ করতে। কিন্তু জল কোথাও পাওয়া গেল না। তিনি ফিরে এসে জানালেন কাছেই গ্রামের পাশে একটা পুকুর আছে কিন্তু তাতে এক ফোঁটা জল নেই। নানক তাকে বললেন, গুরুর নাম নিয়ে আবার সেখানে যাও, জল পাবে। শিষ্যটি এবার সেখানে গিয়ে দেখল, শুষ্ক পুকুর জলে পরিপূর্ণ। অপূর্ব স্বাদ সেই জলের যেন অমৃত ! দয়াময় গুরুরই এই লীলা বুঝতে পেরে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তাঁর অস্তর পূর্ণ হল। লোকে পরে এই পুকুরের নাম দিয়েছে অমৃতসর। সর মানে সরোবর।

এই থেকেই অমৃতসর কথাটির উৎপত্তি। শিখদের চতুর্থগুরু রামদাস ১৫৭৪ খ্রিঃ এখানেই একটি মন্দির স্থাপন করেন। আফগানরা এই মন্দির ধ্বংস করে ১৭৬২ খ্রিঃ। পরে ১৮০২ খ্রিঃ মহারাজা রঞ্জিৎ সিং ওই পুকুর সংস্কার করে স্বর্ণমন্দির স্থাপন করেন। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান। নানক কর্তারপুর গ্রামে ফিরে এসে জীবনের অবশিষ্টকাল অতিবাহিত করে এখান থেকেই তিনি তার ধর্মমত প্রচার করতেন। নানকের প্রচারিত ধর্মমত ছিল সহজ সরল ও অনাড়ম্বর। এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি ছিল না।

সকল ধর্মের মানুষই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। বয়স বেড়ে নানক বার্ধক্যে উপনীত হলেন। তিনি যে শিষ্যসমাজ গঠন করেছেন, তার অবর্তমানে তাদের দায়িত্ব কার ওপরে দেবেন সে বিষয়ে চিন্তিত হলেন নানক। তার নিজের দুই পুত্র, শ্রী চাঁদ ও লক্ষ্মীদাস। শ্রীচাঁদ সাধু হয়ে সমাজ সংসার ছেড়ে সাধনভজন নিয়ে বনেই থাকেন। লক্ষ্মীদাস আবার ঘোরতর বিষয়ী — ঈশ্বর নয় অর্থই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কাজেই এদের কারো ওপরেই ধর্মের বাণী প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া চলে না।

নানকের শিষ্যদের মধ্যে প্রধান যে কয়জন তাঁদের মধ্যে সকলেই ধর্মপরায়ন, ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং তার প্রতি অনুগত। এক কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রধান শিষ্যদের মধ্য থেকেই গুরুগত প্রাণ লেহানাকে তিনি নির্বাচন করলেন। নানক তার শিষ্যদের মধ্যে ঘোষণা করলেন, প্রিয় শিষ্য লেহানাই তাঁর অঙ্গ, তার অবর্তমানে তিনিই ধর্মের বাণী প্রচারের অধিকার লাভ করবেন। নানক লেহনার নতুন নামকরণ করলেন অঙ্গদ। এইভাবেই গুরু নানকের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী হলেন অঙ্গদ।

১৫৩৯ খ্রিঃ নানকের দেহাবসানের পরে এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকই ছিল। উচ্চ কোটির সাধক পুরুষ নানক তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্ন পূর্ব থেকেই জানতে পেরেছিলেন। দিনক্ষণ তিনি শিষ্যদের জানিয়ে দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে শিষ্যরা দলে দলে এসে উপস্থিত হল গুরুর পদপ্রান্তে। সকলেরই হৃদয় ভারাক্রান্ত। নানক তার হিন্দু শিষ্যদের বললেন, ফুল এনে তার ডান পাশে রাখার জন্য।

মুসলমান শিষ্যদের বললেন বাম পাশে রাখার কথা। তারপর জানালেন, যাদের ফুল সতেজ থাকবে তারাই তাঁর দেহ সৎকারের অধিকার লাভ করবে। এরপর তিনি সকলকে প্রার্থনা ও নামগান শুরু করবার নির্দেশ দিলেন। ভজন, নামগান ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে রাত কেটে গেল। ভোর হলে নতুন দিনের সূর্য উঠল। শিষ্যরা সকলে দেখলেন তাঁদের পরমপ্রিয় গুরুর দেহ অদৃশ্য হয়েছে। সেখানে একাকার হয়ে রয়েছে রাশিরাশি তাজা ফুল। গুরুদেবের জয়ধ্বনি দিয়ে সেই প্রসাদী ফুলই সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শিষ্যরা গভীর শ্রদ্ধায় মাথায় তুলে নিলেন।

এই ভাবেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে মিলনের সেতু রচনা করে গেলেন গুরু নানক। ঈশ্বর প্রেম ব্যক্ত হবার জন্য নানকের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল কবিত্বশক্তি। তিনি অনেক ভজন রচনা করেছেন। আধ্যাত্মিক জগতের চিরকালীন সম্পদ এই ভজনগুলো জপজী নামক গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে। নানক বলতেন, সৎ ও সাধু পুরুষেরা দেবতার চেয়েও বড়। কারণ সাধু মহাত্মারা কামনা – বাসনা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। কিন্তু দেবতারা কামনা – বাসনার অধীন।

তিনি আরও বলতেন, গুরুর মধ্য দিয়েই মানুষ ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। প্রকৃত সাধু ব্যক্তিই গুরু হওয়ার উপযুক্ত। গুরু নানকের উপদেশ হল, পরনিন্দা না করাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। নিজেকে যে জানে সে ঈশ্বরকে জানে। হিন্দু বা মুসলমান, এগুলো পরিচয় নয়। মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ।

গুরু নানক এর মৃত্যু: Guru Nanak’s Death

15 এপ্রিল 1469 গুরু নানক এর জীবনাবসান হয়।

Leave a Comment