জগদীশচন্দ্র বসু জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali. আপনারা যারা জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে জানতে আগ্রহী জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
জগদীশচন্দ্র বসু কে ছিলেন? Who is Jagadish Chandra Bose?
জগদীশ চন্দ্র বসু (৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ – ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭) সিএসআই, সিআইই, এফআরএস একজন বাঙালি পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় তার হাত ধরে হয় বলে মনে করা হয়। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক হিসেবে অভিহিত করে।
জগদীশচন্দ্র বসু প্রাচীন ভারতে দর্শন ও বিজ্ঞানের সাধনার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। প্রকৃতি ও প্রাণ -এই দুই এর নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করে যে বোধী সেদিন ভারতবর্ষ অর্জন করেছিল, পরবর্তী কালে তা বিজ্ঞ জনের বিস্ময় উৎপাদন করেছিল। কিন্তু কালের ব্যবধানে এক দুঃসাহ অধঃপতনের মধ্য দিয়ে এই ভারত ভূমিতেই বিজ্ঞান সাধনা ও দর্শন – সাধনার মধ্যে ঘটেছিল অবাঞ্ছিত বিচ্ছেদ। অন্ধ কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল ভারত।
সৌভাগ্যক্রমে মহাকালের বিবর্তন ধারায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের স্বক্ষেত্রে নবজাগরণের যে মুক্ত – ধারার প্রাদুর্ভাব ঘটে এর ফলে আত্ম বিস্মৃতির দীর্ঘ সুষুপ্তি থেকে উত্থিত হয় নবীন ভারত। সেই নব – জাগৃতির সন্ধিলগ্নে ভারত ভূমিতে উদবোধনের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন যে মুষ্টিমেয় মনীষীবৃন্দ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র তাঁদের অন্যতম। তাঁর বিজ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের দর্শন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ধারার মধ্যে ঘটেছিল আশ্চর্য সেতুবন্ধন ৷
জগদীশচন্দ্র বসু জীবনী – Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali
নাম | জগদীশচন্দ্র বসু |
জন্ম | 30th নভেম্বর 1858 |
পিতা | ভগবান চন্দ্র বসু |
মাতা | – |
জন্মস্থান | বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ) |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
পেশা | পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী |
মৃত্যু | 23rd নভেম্বর 1937 (বয়স 78) |
জগদীশচন্দ্র বসু এর জন্ম: Jagadish Chandra Bose’s Birthday
জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
জগদীশচন্দ্র বসু এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Jagadish Chandra Bose’s Parents And Birth Place
১৮৫৮ খ্রিঃ ৩০ শে নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ঢাকা জেলার রাড়িখাল গ্রামে জন্ম হয়েছিল জগদীশচন্দ্রের। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। স্বদেশপ্রেম ও শিল্পানুরাগ ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই দুটি গুণ লাভ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র।
মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সরলতা ও উদার প্রকৃতি। অতিবাল্য বয়সেই মায়ের মুখে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী শুনে ভারতের সংস্কৃতির সনাতন ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
জগদীশচন্দ্র বসু এর ছোটবেলা: Jagadish Chandra Bose’s Childhood
সরকারী উচ্চপদে আসীন হলেও ভগবানচন্দ্র তৎকালীন সময়ের পাশ্চাত্য শিক্ষাভিমানী তথাকথিত শিক্ষিতও বিত্তবানদের মত উন্মার্গগামী ছিলেন না। জনসমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কখনোই বিচ্ছিন্ন বা শিথিল হয়ে যায়নি। শিক্ষাদানের জন্য তিনি পুত্রকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন।
এখানে গ্রামের সাধারণ মানুষের সন্তানদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে বালক জগদীশচন্দ্র তাদের ধ্যান – ধারণা ও কল্পনা অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেছিলেন। জগদীশচন্দ্রের জীবন – পাত্রে সঞ্চিত শৈশবের এই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনকে পরিপূর্ণতার পথে এগিয়ে নিতে সহায়ক হয়েছিল। গ্রামের সাধারণ শিল্পী – কারিগরদের কাছাকাছি থেকে জগদীশচন্দ্র কর্মকুশলতার যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তার জীবনে তা ব্যর্থ হয়নি।
জগদীশচন্দ্র বসু এর শিক্ষাজীবন: Jagadish Chandra Bose’s Educational Life
ফরিদপুরের পাঠশালায় শিক্ষা লাভের পর জগদীশচন্দ্রকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় কলকাতার হেয়ার স্কুলে। পরে সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ৷ এই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং সেন্টজেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন।
এই সময়ে তিনি পদার্থ বিদ্যার প্রখ্যাত অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ – এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জগদীশচন্দ্র বিলেত যাত্রা করেন। কেমব্রিজ থেকে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় ট্রাইপোস সহ বি.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি পাস করেন।
জগদীশচন্দ্র বসু এর কর্ম জীবন: Jagadish Chandra Bose’s Work Life
দেশে ফিরে এসে জগদীশচন্দ্র অধ্যাপনাকেই জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর অন্তরে ছিল অনুসন্ধিৎসার গভীর আকুলতা।
প্রেসিডেন্সি কলেজে শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য তাঁর আত্মমর্যাদাবোধে পীড়া সৃষ্টি করত। এই অন্যায় ব্যবস্থার প্রতিবাদে তিনি তিন বছরকাল কোন বেতন গ্রহণ করেন নি। প্রবল অর্থ সংকটের মধ্যেও তিনি তাঁর বিজ্ঞানের সাধনা অব্যাহত রাখলেন। কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করলেন না বিজাতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
শেষ পর্যন্ত জগদীশচন্দ্রের আত্ম – সম্ভ্রমবোধ জয়যুক্ত হল। কলেজ কর্তৃপক্ষ শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় অধ্যাপকদেব সমহারে বেতন দেবার যৌক্তিকতা মেনে নিলেন। ইতিমধ্যে ব্যয় হল্যের কারণে তাঁর পিতা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিন বছরের বেতনের বকেয়া টাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিলে সেই টাকায় জগদীশচন্দ্র পিতাকে ঋণমুক্ত করলেন।
জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞানচর্চা
সেই সময়ে পরাধীন দেশে বিজ্ঞানী হওয়ার পথে ছিল নানাবিধ অন্তরায়। সহস্র দুঃখ – অপমানের বোঝা মাথায় নিয়েই জগদীশচন্দ্রকে বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। সার্থকতাও একদিন এল। দীর্ঘ অক্লান্ত গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন তিনি।
বিদ্যুৎ – তরঙ্গ বিষয়ে তার আবিষ্কার বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল। আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পথিকৃৎ জগদীশচন্দ্র। তার বিজ্ঞান সাধনাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়।
তার বিজ্ঞান – সাধনার প্রথম পর্যায়ের বিস্তৃতি ১৮৯৫ খ্রিঃ থেকে ১৮৯৯ খ্রিঃ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল পদার্থ বিদ্যার বিদ্যুৎ – চুম্বকীয় তরঙ্গ। জার্মানীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী হেনরিখ হার্জ আলোর ওপর পরীক্ষা – নিরীক্ষা করতে গিয়ে রামধনুর সাতটি রঙের রহস্যে আটকা পড়েন। আমাদের দৃষ্টির নাগালে ধরা পড়ে যে সব রং তা হলো বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। কিন্তু অতিবেগুনি ও অবলোহিত দুটি রং আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না।
অতিবেগুনি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অত্যন্ত কম এবং অবলোহিতের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অত্যস্ত বেশি -এই কারণে এই দুটি রং আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এই দুই রঙকে দৃষ্টিগোচর করবার পন্থা আবিষ্কারের জন্য হার্জ এবং জগদীশচন্দ্র একই ভাবে চিন্তাভাবনা করেছেন। তাঁরা দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে প্রাকৃতিক আলো পাঠিয়ে সব মুখীন আলোকে মেরুমুখী আলোতে রূপান্তরিত করেন। ফলে অদৃশ্য আলো বিদুৎমকের মতো দৃষ্টিগোচর হয়েই আবার নিরুদ্দেশ হয়। জগদীশচন্দ্র এই আলোর নাম দেন ব্রোকেন গ্লিম্পস্ অব ইনভিজিবল লাইট।
বেতার গবেষণার কাজেও জগদীশচন্দ্র যখন ব্যস্ত ছিলেন একই সময়ে ইতালিয় বিজ্ঞানী মার্কোনিরও গবেষণার বিষয় ছিল অভিন্ন। ১৮৯৫ খ্রিঃজগদীশচন্দ্র বিলাতে বিখ্যাত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে আলো সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রদর্শন করে সমবেত বিজ্ঞানীদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করেন।
হার্ৎজের আলোর ওপরে জগদীশচন্দ্র নতুন আলোকপাত ঘটিয়ে ইংলন্ডের পদার্থবিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বেতার আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। যদিও দুর্ভাগ্যবশতঃ তার গৌরব লাভ করেছিলেন ১৮৯৬ খ্রিঃ ইতালিয় বিজ্ঞানী মার্কোনি।
উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের সাড়া আবিষ্কার কেবল নয়, ভূণবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় চমকপ্রদ সব আবিষ্কারের মাধ্যমে জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানক্ষেত্রে পশ্চিমী আধিপত্য খর্ব করে ভারতীয় বিজ্ঞানীর জয়ধ্বজা উত্তোলন করেছিলেন।
বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে বেতার যোগাযোগ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার প্রথম সফল পরীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। তার নির্মিত রেডিয়েটারের মাধ্যমে তড়িৎ তরঙ্গের গতি ছিল পঁচাত্তর ফুট পর্যন্ত।
১৮৯৫ খ্রিঃ বিলেত থেকে ফিরে এসে এবারে আর পদার্থবিদ্যা নয় জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় হল প্রাণিবিদ্যা। ভারতের সনাতন ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের মনে প্রশ্ন জেগেছিল সৃষ্টির মধ্যে জড় ও চেতন এই যে দুই সমান্তরাল ধারা প্রবাহিত এর মধ্যে কি কোন যোগসূত্র নেই ?
সৃষ্টির সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে চেতমার মহাসমুদ্র প্রবহমান – জড় বা অবচেতন বলে সেখানে কিছু নেই — এই হল সনাতন ভারতের মনীষার চিরন্তন ঘোষণা। ইউরোপের জড়বাদী বিজ্ঞানীরা এই সত্য স্বীকার না করলেও জগদীশচন্দ্র এই ঘোষণার সত্যতা নিরূপণে যত্নবান হলেন। তার পরীক্ষার স্থান হল ঘন জঙ্গল। অনতিকালের মধ্যেই তিনি তার উদ্ভাবিত তড়িৎ তরঙ্গ গ্রাহক যন্ত্র বা কোহিয়ারারের সাহায্যে দেখিয়ে দিলেন ক্রমাগত ব্যবহারের পর ধাতুর ক্লান্তি বা মেটালিক ফ্যাটিগ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সামান্য বিশ্রামের পরেই এই ধাতব ক্লান্তি মুছে যায়।
টানা দুই বছরের গভীর গবেষণার পর লন্ডনের রয়েল সোসাইটিতে জগদীশচন্দ্র কোহিয়ারারের মাধ্যমে জড়ের শরীরে চেতনার আভাস তুলে ধরলেন। এই গবেষণা সংক্রান্ত তাঁর গবেষণাপত্রটির নাম রেসপন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন লিভিং বা জীবন ও জড়ের সাড়া। জগদীশচন্দ্রের এই আবিষ্কার বিশ্ববিজ্ঞানের অঙ্গনে আলোড়ন তুলল। ভারতীয় বিজ্ঞানী বিশ্ববিজ্ঞানীর সম্মান ও মর্যাদা লাভ করলেন।
পরবর্তীকালে নিজের তৈরি নানান যন্ত্রের সাহায্যে জগদীশচন্দ্র বিশ্ববিজ্ঞান ক্ষেত্রে তুলে ধরেন উদ্ভিদের প্রাণের সাড়ার প্রমাণ। এই সত্যও তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন লন্ডনে রয়েল সোসাইটির মঞ্চে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সামনে ১৯০১ খ্রিঃ।
উদ্ভিদের নাড়ীর স্পন্দন ধরবার জন্য জগদীশচন্দ্র তৈরি করে নিয়েছিলেন একটি যন্ত্র। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতই নির্দিষ্ট ছন্দে উদ্ভিদের স্পন্দন রেখা ফুটে উঠল সেই যন্ত্রের পর্দায়। ১৯০১ খ্রিঃ জগদীশচন্দ্রের এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটি যে সকল বিজ্ঞানীই মেনে নিলেন তা কিন্তু নয়। অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মত জগদীশচন্দ্রকেও বিরোধিতার ঝড়ের সম্মুখীন হতে হল।
যেসব শারীরবিদ সজীব কোষে প্রাণ – রসায়নের ক্রিয়াপদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন, প্রধানতঃ তারাই বিরোধিতা করলেন জগদীশচন্দ্রের। আবার এই শারীরবিদদেরই আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত রয়েল সোসাইটিতে। ফলে জগদীশচন্দ্রের প্রবন্ধ রেসপন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন লিভিং সোসাইটির সংগ্রহে প্রকাশের অনুমতি থেকে বঞ্চিত হল। কিন্তু সেদিন উদ্ভিদবিদ্যায় জগদীশচন্দ্র পদার্থবিদ্যার সাধারণ সূত্রগুলি যেভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার দ্বারা জীব – পদার্থবিদ্যা বা বায়োফিজিক্সের গোড়াপত্তন সকলের অজ্ঞাতে সাধিত হয়েছিল।
জড়ের মধ্যেও জীবন – ভারতীয় দর্শনের এই মূল সত্যটি জগদীশচন্দ্রে বস্তুবাদী পরীক্ষার মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই চরম সত্যকেও সেদিন অস্বীকার করেছিলেন ঈর্ষাকাতর ও বিদ্বেষভাবাপন্ন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর দল। কিন্তু ভারতের জন্য নিবেদিত প্রাণ অপর এক বিদুষী বিদেশিনী সেদিন অকুন্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রকে।
এই বিদেশিনী হলেন ভারত-বিবেক বিবেকানন্দের মানস-কন্যা ভগিনী নিবেদিতা। পরবর্তীকালে এই নিবেদিতাই হয়ে উঠেছিলেন জগদীশচন্দ্রের জীবনের অন্যতম প্রেরণাদাত্রী। ইংলন্ডে ব্রিটিশ শারীরবিদগণ যখন জগদীশচন্দ্রের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে, আইরিশ কন্যা নিবেদিতা উপযুক্ত জবাব দিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের জীবনে বঞ্চনার ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। পদার্থবিদ্যায় বেতার যোগাযোগের ভিত্তি স্থাপন করেও তিনি গৌরবের অধিকারী হতে পারেন নি। তা আত্মসাৎ করেছিলেন ইতিালিয় পদার্থবিদ গুগলিয়েলমো মার্কোনি।
বিশ্ববিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্রই প্রথম অত্যন্ত কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সূক্ষ্ম তরঙ্গ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এই সূক্ষ্ম তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে তিনি বিভিন্ন পদার্থের গঠন সনাক্ত করেন। পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্রের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য যন্ত্রটি হল ওয়েভ গাইড বা তরঙ্গ পথ – প্রদর্শক। পরবর্তীকালে এই যন্ত্রের সাহায্যেই সংবেদনশীল ইলেকট্রনিক ও পারমাণবিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়। বিশ্ববিজ্ঞানে ওয়েভ গাইড জগদীশচন্দ্রের এক মূল্যবান সংযোজন।
ক্রেসকোগ্রাফ জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত অপর একটি বিখ্যাত যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি উদ্ভিদের বৃদ্ধির হার মেপেছিলেন। এতেই ধরা পড়েছিল উদ্ভিদের সাড়া ও চলন।
সমকালের প্রেক্ষিতে জগদীশচন্দ্রের ধ্যানধারণা এতটাই অগ্রসর ছিল যে তার মূল্যায়ন সম্ভব হয়নি। স্বল্পবুদ্ধি সমকালীন বিজ্ঞানের সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছিল তাকে। বিশ্ববিখ্যাত বিশ্বকোষ গ্রন্থ দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা গ্রন্থে (১৯৪৫ খ্রিঃ) এই সত্য স্বীকার করে জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে বলা হয়েছে- ”. ……… so much advance of his time that its precise evaluation was not possible .”
১৯১৫ খ্রিঃ সাতান্ন বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে ত্রিশ বছর অধ্যাপনার পর জগদীশচন্দ্র এমেরিটাস প্রফেসর (অবৈতনিক প্রধান অধ্যাপক) হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। প্রায় একই সময়ে রসায়ন বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ইতিমধ্যে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বোস রিসার্চ ইনসটিটিউট। ১৯১৭ জগদীশচন্দ্র চলে এলেন এখানে ৷
তিনিই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাপক ও পরিচালক। এখানেই তাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হল নতুন ধারার গবেষণা। তাঁর প্রতিভার দীপ্তি বিশ্ব বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়তেও বিলম্ব হল না।
জগদীশচন্দ্র বসু এর পুরস্কার ও সম্মান: Jagadish Chandra Bose’s Awards And Honors
১৯১৬ খ্রিঃ জগদীশচন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ১৯২০ খ্রিঃ রয়েল সোসাইটি তাঁকে ফেলো নির্বাচিত করে সম্মান জানাল। তাঁর যুগোত্তীর্ণ প্রতিভাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ভারতীয় মনীষীবৃন্দ ৷ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ।
মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন জগদীশচন্দ্র। বাংলায় রচিত তার নানা বিষয়ের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলি সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ রূপে স্বীকৃত।
জগদীশচন্দ্র বসু এর মৃত্যু: Jagadish Chandra Bose’s Death
১৯৩৭ খ্রিঃ ২৩ শে নভেম্বর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের জীবনাবসান হয়।