মেরী কুরি জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Marie Curie Biography in Bengali. আপনারা যারা মেরী কুরি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী মেরী কুরি র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
মেরী কুরি কে ছিলেন? Who is Marie Curie?
মারি ক্যুরি (ফরাসি: Marie Curie) প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই পোলীয় ও ফরাসি বিজ্ঞানী ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তার স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার জেতেন। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম মহিলা অধ্যাপক ছিলেন এবং তিনই ছিলেন প্রথম মহিলা যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়।
মেরী কুরি জীবনী – Marie Curie Biography in Bengali
নাম | মেরী কুরি |
জন্ম | 7 নভেম্বর 1867 |
পিতা | Marie Salomea Skłodowska Curie |
মাতা | – |
জন্মস্থান | ওয়ারশ, কংগ্রেস পোল্যান্ড, রাশিয়ান সাম্রাজ্য |
জাতীয়তা | পোলীয়, ফরাসি |
পেশা | বিজ্ঞানী |
মৃত্যু | 4 জুলাই 1934 (বয়স 66) |
মেরী কুরি র জন্ম: Marie Curie’s Birthday
১৯৩৭ খ্রিঃ ২৩ শে নভেম্বর মেরী কুরি এর জীবনাবসান হয়।
মেরী কুরি র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Marie Curie’s Parents And Birth Place
বিশ্ববিজ্ঞানের মহানায়িকা মেরি কুরি, মাদাম কুরি নামেই সমধিক পরিচিতা। রেডিয়াম ও পোলনিয়াম এই দুই তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করে তিনি পদার্থ ও রসায়ন বিদ্যার মহাসম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মাদাম কুরির সম্পূর্ণ নাম মার্জা ক্লোডোস্কা। তিনি পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে ১৮৬৭ খ্রিঃ ৭ ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে মার্জা সর্বকনিষ্ঠ।
বাবা স্থানীয় একটি স্কুলের পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক। মাও সুশিক্ষিতা, ব্যক্তিত্বময়ী। সংসারের খরচ সংকুলানের জন্য তিনি মেয়েদের পড়াবার জন্য একটা স্কুল খুলেছিলেন।
মেরী কুরি র শিক্ষাজীবন: Marie Curie’s Educational Life
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই লিখতে পড়তে শিখে গিয়েছিলেন মার্জা। তার পড়ার আগ্রহও ছিল প্রবল। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প থেকে শুরু করে জ্ঞান – বিজ্ঞানের বই, নানা আবিষ্কারের গল্প, যখন যা হাতের নাগালে পেতেন সব গোগ্রাসে গিলতেন। পনের বছর বয়সের মধ্যেই তিনি রুশ ও জার্মান দুই ভাষাই ভালভাবে শিখে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বাবাই ছিলেন উৎসাহদাতা।
মাত্র এগারো বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা গেলেন। সেই সময় এই মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক বলতে কিছুই ছিল না। মার্জার দিদি ব্রনিয়া এবং দাদা জোজিও হাইস্কুলে সেরা ফল করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। মার্জাও একই স্কুল থেকে সবচেয়ে ভাল ফল করে স্নাতক হলেন, পেলেন স্বর্ণপদক। ছেলেমেয়েদের স্কুলের ফলাফলের জন্যই ক্লোডোস্কার পরিবার অঞ্চলে বিশেষ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল।
ষোল বছর বয়সে স্কুল থেকে বেরিয়ে মার্জা স্থির করলেন প্যারিস যাবেন ডাক্তারি পড়বার জন্য। কিন্তু বাবার আর্থিক সামার্থ্য ছিল সীমিত। বড়দি ব্রনিয়ারও সাধ প্যারিসে গিয়ে ডাক্তারি পড়বেন। প্যারিসে রেখে দুই মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবার মত সঙ্গতি বাবার ছিল না। বাবার মুখে এই নিদারুণ কথা শুনে মার্জার মন ব্যথিত হলেও হতাশ হলেন না। তিনিই বাবাকে আশ্বস্ত করে জানালেন যে দিদিই আগে প্যারিসে পড়তে যাবে। তার পড়ার খরচ জোগাবার জন্য তিনি এখানে কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নেবেন।
দিদি পাশ করে দেশে ফিরে এলে তিনি সেখানে যাবেন। তখন তার পড়ার খরচ চালানো দিদির পক্ষে অসম্ভব হবে না। এই ব্যবস্থা মতই দিদি ব্রনিয়া প্যারিস চলে গেলেন। আর তার পড়ার খরচ চালাবার জন্য মার্জা ওয়ারশতেই এক ধনী পরিবারে গভর্নেসের চাকরি নিলেন। সেখানে বাড়ির কর্ত্রী ছিলেন খুবই বদমেজাজী। ফলে মার্জা বছরখানেকের বেশি টিকে থাকতে পারলেন না।
কিন্তু কাজ ছাড়া থাকবার তো উপায় ছিল না। দিদিকে প্যারিসে নিয়মিত খরচের টাকা পাঠাতে হয়। চেষ্টা চরিত্র করে এবারে এক রুচিসম্পন্ন ভদ্র পরিবারে কাজ পেলেন — সেই গভর্নেসেরই। এখানে পরিবারের আবহাওয়ার সঙ্গে সহজেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন। কিন্তু সুখ তো বেশিদিন কপালে সয় না। মার্জারও তাই হল।
ঘটনাক্রমে পরিবারের এক সুদর্শন যুবকের সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েন। কিন্তু বিয়ে সম্ভব হল না। অভিজাত পরিবারের ছেলের সঙ্গে সামান্য বেতনভূক পরিচারিকার বিবাহ যে অকল্পনীয় ব্যাপার। যুবকটি তার অভিভাবকদের কথা জানিয়ে মার্জার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওতেই শেষ হয় না। পরিবারের কর্তারা কাজ থেকে ছাঁটাই করলেন মার্জাকে। চরম হতাশা ও অপমান নিয়ে আবার নতুন করে কাজের সন্ধানে নামতে হল মার্জাকে।
এমনি জীবন – সংগ্রামের কঠিন পথে চলতে চলতে মার্জা অল্প বয়সেই যথেষ্ট পরিণত হয়ে উঠলেন। প্রতিকূলতার মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে লড়াই করবার প্রেরণা তিনি এভাবেই লাভ করেছিলেন। পাঁচ বছর প্যারিসে পড়াশোনা করে দিদি ব্রনিয়া ডাক্তার হলেন। কিন্তু তিনি আর দেশে ফিরলেন না। সেখানেই এক যুবককে বিয়ে করে সংসার পাতলেন। গোটা পরিকল্পনাটাই পাল্টে গেল। মার্জার আর ডাক্তারী পড়তে প্যারিস যাওয়া হল না। খরচ যোগাবে কে ?
উনিশ শতকের শেষ দিকে পোল্যান্ড ছিল রাশিয়ার জারতন্ত্রের শাসনাধীন। মার্জার তরুণী বয়সকালে পোল্যান্ডে রুশ – বিরোধী স্বাদেশিকতার আবহাওয়া জোরদার হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার আন্দোলনে মার্জার শিক্ষক পিতা ছিলেন অন্যতম পুরোধা পুরুষ। মার্জাও বাবার সঙ্গে আন্দোলনে ভিড়ে গেলেন।
মেরী কুরি র প্রথম জীবন: Marie Curie’s Early Life
পোল্যান্ডের নানাস্থানে গোপনে স্বদেশী স্কুল গড়ে উঠেছিল। তেমনি একটি স্কুলে মার্জা শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতে লাগলেন। তিনি ছাত্রদের পড়াতেন অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন। এইভাবে দুবছর কাটল। ১৮৯১ খ্রিঃ প্যারিস থেকে দিদি ব্রনিয়া হঠাৎ চিঠি পাঠালেন পত্রপাঠ সেখানে চলে যাবার জন্য। মার্জার ডাক্তারী পড়ার খরচ তিনিই জোগাবেন। এতদিন পরে আশার আলো আবার মার্জাকে আশ্বান্বিত করে তুলল। কোনবকমে পথ খরচ সংগ্রহ করে তিনি প্যারিসে রওনা হয়ে পড়লেন।
প্যারিসে পৌঁছে মার্জা কিন্তু দিদির সঙ্গে দেখা করলেন না। সুখী সংসারের গৃহিণী ব্রনিয়া। তার ওপরে ততদিনে একটি সন্তানও হয়েছে তার। সংসারে খরচ তো বেড়েছে। এর ওপর বোঝা হয়ে উপস্থিত হলে দিদি তো কোন সময়ে স্বামীর বিরাগভাজন হয়ে উঠতে পারেন। এমনি সাত – পাঁচ ভেবে মার্জা দিদির বাড়িতে আর গেলেন না। প্যারিসের আলোক – বাতাসহীন বস্তি অঞ্চল লাতিন কোয়ার্টারে নামমাত্র ভাড়ায় মাথা গোজার মত একচিলতে একটা ঘর ভাড়া করলেন। নরকতুল্য সেই নোংরা, চোর জোচ্চোর – ভবঘুরে ভরা পরিবেশে নতুন জীবন শুরু হলো মার্জার।
যেই স্বপ্ন নিয়ে প্যারিসে এসেছিলেন, তা বাতিল করে ভর্তি হলেন প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিদ্যার ক্লাশে। এখানে নিজের নামও পাল্টে ফেললেন। মার্জার নতুন নাম হল মেরি ক্লোডোস্কো। চরম দারিদ্র্য, অনাহারে ও অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন মার্জা। দিদি এই কৃচ্ছ্রসাধনের বিন্দুবিসর্গ – ও জানতে পেলেন না। বছর দুই এভাবেই কাটল।
কিন্তু দীর্ঘদিন অনাহারে আধপেটা খেয়ে শরীর একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল, জীবনীশক্তিও ণেষ বিন্দুতে এসে পৌঁচেছিল। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করতে করতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। সহপাঠীদের শুশ্রুষায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে শুনলেন, ডাক্তার জানিয়েছেন, পুষ্টির অভাবে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। বন্ধুরাই ডায়েরী হাটকে দিদি ব্রনিয়ার ঠিকানা জোগাড় করল। ব্রনিয়া খবর পেয়ে ছুটে এসে কঙ্কালসার বোনকে বাড়িতে নিয়ে তুললেন।
দিদির আন্তরিক সেবাযত্নে সে যাত্রা প্রাণরক্ষা হল মার্জার। সুস্থতা ফিরে পেতেই আবার ফিরে এলন নিজের লাতিন কোয়ার্টারের নরকে। ব্রনিয়ার অনেক কাকুতি মিনতিতেও নিজের কঠিন জীবনসাধনার পরিবর্তন ঘঠালেন না। ১৮৯৩ খ্রিঃ মার্জা সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক হলেন। পরের বছর গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলেন। এতদিন পরে একটু হাঁপ ছাড়বার অবকাশ পেলেন মার্জা।
মেরী কুরি র কর্ম জীবন: Marie Curie’s Work Life
এই সময়েই একদিন তার এক বন্ধু কোভলস্কির বাড়িতে আলাপ হল পদার্থবিদ্যার এক তরুণ গবেষকের সঙ্গে। তাঁর নাম পিয়েরি কুরি। এই ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের সূক্ষ্ম পরিমাপক যন্ত্র ও পিজো বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। পরবর্তীকালে আদর্শবাদী গবেষণা পাগল এই তরুণ গবেষকই মার্জাকে জীবনসঙ্গিনী করে নেন। মার্জা হলেন মাদাম কুরি। সময়টা ১৮৯৫ খ্রিঃ। বিশ্ববিজ্ঞানের পরম বিস্ময়কর দম্পতির জীবনের যাত্রারম্ভ হয় এভাবেই।
পিয়েরি প্যারিসের এক মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পড়ান। তবে গবেষণার সূত্রে পদার্থবিদ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছেন। আর্থিক অবস্থা খুব সুবিধের নয়। মাসমাইনের সামান্য টাকাতেই দুজনে মিলে কোনরকমে সংসার সামলাতে লাগলেন। এরই মধ্যে তাদের স্বপ্ন দেখারও বিরাম নেই। বিয়ের দু বছর পরেই ১৮৯৭ খ্রিঃ কুরি দম্পতির প্রথম কন্যাসম্ভান আইরিনের জন্ম হল। কুরি দম্পতির এই প্রথম কন্যাটি পরবর্তীকালে পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন।
১৯২৬ খ্রিঃ আইরিনের বিয়ে হয়েছিল রেডিরিক জোলিয়েট নামের এক পদার্থ বিজ্ঞানীর সঙ্গে। স্বামী – স্ত্রী একসঙ্গে গবেষণা করে ১৯৩৫ খ্রিঃ নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। আইরিনের জন্মের কয়েক বছর পরেই দ্বিতীয় কন্যা ইভার জন্ম হয়। সংসারের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে খরচ। কিন্তু সম্বল তো সেই মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাসমাইনের টাকা। সংসারের সব অভাব – অভিযোগ ভুলে রইলেন কুরি দম্পতি নিজেদের গবেষণার মধ্যে ডুবে থেকে।
১৮৯৬ খ্রিঃ হেনরি বেকেরেল নামে এক ফরাসি বিজ্ঞানী ইউরেনিয়াম ঘটিত খনিজ থেকে এক রশ্মি আবিষ্কার করেন। তার নাম গামা রশ্মি। এই আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে থাকেন যে ইউরেনিয়াম বা তার কোনও যৌগের অবশ্যই আলো শোষণের ক্ষমতা রয়েছে। সেই আলোই নিশ্চয় রশ্মির আকারে বিচ্ছুরিত হয়। বিজ্ঞানীরা অনুমানই যা করেছিলেন, ভাবনার স্বপক্ষে কোন বাস্তব প্রমাণ খাড়া করতে পারছিলেন না।
পিয়েরি মার্জাকে পরামর্শ দিলেন এই সম্যসাটিকে নিয়েই তার ডক্টরেটের থিসিস তৈরি করতে। গবেষণার কাজে নানা সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দরকার। কিন্তু সেসব কিনবার টাকা কোথায় ? মার্জা হতাশ না হয়ে স্বামীর তৈরি যন্ত্রপাতি, বিকিরণ পরিমাপে যন্ত্র — এসব নিয়েই গবেষণার জন্য তৈরি হলেন। পিয়েরি যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, সেখানে একটি পরিত্যক্ত ঘর ছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানেই ল্যাবরেটরি গুছিয়ে নেওয়া হল। তারপর দুজনে মিলে আরম্ভ করলেন গবেষণা।
মার্জা দেখলেন, ইউরেনিয়াম ঘটিত যৌগই কেবল নয়, ইউরেনিয়াম ধাতু থেকেও রহস্যময় বিকিরণ বেপরোয়াভাবে বেরিয়ে আসছে। এই বিকিরণের গোপন উৎস সন্ধান করতে গিয়ে মার্জা লক্ষ করলেন পরমাণুর মধ্যেই রয়েছে এই গোপন উৎস। বিকিরণের বৈশিষ্ট্যটি ইউরেনিয়াম ধাতুরই একটা পারমাণবিক অবস্থা। বিকিরণের এই বৈশিষ্ট্যই হল রেডিও অ্যাকটিভিটি। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে এমন কোন মৌল আরও আছে কিনা, সেই অনুসন্ধান কাজে এবারে মার্জা আত্মনিয়োগ করেন।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের কাজে নানা খনিজ খুঁজতে খুঁজতে মার্জা খুঁজে পান পিচ ব্লেড। এর মধ্যেই পাওয়া গেল ভয়ঙ্কর সেই বিকিরণ। ইউরেনিয়ামেরই অনুরূপ সেই বিকিরণ এই খনিজের সারা অবয়ব জুড়ে। আরও একটা ব্যাপার হল, খনিজ পিচ ব্লেড থেকে যে বিকিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তার তেজ ইউরেনিয়ামের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ধীরে ধীরে মার্জা খনিজ পিচ ব্লেড থেকে বিশুদ্ধ অবস্থা অর্থাৎ বিশেষ তাপমাত্রায় কতগুলো পদার্থ যোগ করে নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এক ধরনের মৌলকে আলাদা করে নিলেন।
স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘ চার বছরের পরীক্ষা – নিরীক্ষার পর অবশেষে প্রকৃতির এক অজানা রহস্যের উন্মোচন ঘটানো সম্ভব হয়। মার্জা দুটি সম্পূর্ণ নতুন মৌল আবিষ্কার করে পৃথক করে নেন। এই মৌল দুটোর একটির নাম দিলেন পোলনিয়াম। — মাতৃভূমি পোল্যান্ডের নামে এই মৌলটিকে উৎসর্গ করে এই নাম দিলেন। দ্বিতীয় মৌলটির নাম দেন রেডিয়াম। ইউরেনিয়াম নামের এক অংশ ছেঁটে রেডিয়েশন বা বিকিরণ শব্দের রেডি বসিয়ে নামকরণ করা হল।
নতুন আবিষ্কৃত রেডিয়াম মৌলটির তীব্রতা ইউরেনিয়ামের তুলনায় পনের লক্ষ গুণ বেশি। পিয়েরির তৈরি বিকিরণের পরিমাণ পরিমাপের যন্ত্রই তা বলে দিল। এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন উঠল। কুরি দম্পতির এই মহৎ গবেষণার স্বীকৃত হিসেবে হেনরি বেকেরেলের সঙ্গে যুক্তভাবে তাদের দেওয়া হল ১৯০৩ খ্রিঃ পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার।
অসুস্থতার জন্য তাদের কারোর পক্ষেই সুইডেনের রাজধানী স্টকহলমে গিয়ে পুরস্কার নেওয়া সম্ভব হয়নি। আশ্চর্য যে এই বিজ্ঞানী দম্পতির জন্য ফরাসি সরকারের কোন তাপ উত্তাপ দেখা গেল না। না দেওয়া হল তাদের কোন আর্থিক সাহায্য না করে দেওয়া হল একটি ভাল লাবরেটরি। কোন সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা। গবেষণার সুবাদে কেবল ১৯০৪ খ্রিঃ মাদাম কুরি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন।
রেডিয়াম ও পোলনিয়াম আবিষ্কার ও এই দুটি ধাতব মৌলের নিষ্কাশন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর বিশ্ববিজ্ঞানে নতুন একটি শাখার উদ্ভব হল। তার নাম রেডিয়েশন সায়েন্স বা তেজস্ক্রিয় বিজ্ঞান। মার্জা রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন বটে, এর তেজস্ক্রিয়তার স্বরূপ তিনি নির্ণয় করে উঠতে পারেন নি। তার অসম্পূর্ণ কাজটি করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ১৯০২ খ্রিঃ। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে এই তেজস্ক্রিয়তা হল আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের স্বতঃস্ফুর্ত ভাঙ্গন দশা।
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রচণ্ড চাপে অবস্থিত মৌল কণিকা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যাগত তারতম্যের ফলেই ঘটল ভাঙ্গন দশা। নিউক্লিয়াসের এই বিশেষ অবস্থার কথা রাদারফোর্ডই সর্বপ্রথম বিশ্ববিজ্ঞানকে অবহিত করেন। ১৯০৬ খ্রিঃ ১৯ শে এপ্রিল, প্যারিসের এক রাস্তায় আকস্মিক দুর্ঘটনায় পিয়েরি কুরির আকস্মিক মৃত্যু হয়।
এই বিপর্যয়ের কিছুদিন পরেই মাদাম কুরি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদে মনোনীত হলেন। মাদাম কুরিই হলেন ফ্রান্সের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে প্রথম মহিলা যিনি অধ্যাপনার আসনে ব্রতী হন।
মেরী কুরি র পুরস্কার ও সম্মান: Marie Curie’s Awards And Honors
১৯১১ খ্রিঃ দ্বিতীয়বার নোবেল পেলেন মাদাম কুরি। এবারে পদার্থ বিদ্যায় নয় — রসায়নে। রেডিয়ামকে বিশুদ্ধ মৌলরূপে পৃথক করা ও তার পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করার কৃতিত্বের জন্যই তিনি এই পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
এই সুবাদে ফরাসি সরকার মাদাম কুরিকে একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি উপহার দিয়ে তাঁদের পূর্বেকার ভুলের সংশোধন করলেন। এই ল্যাবরেটরির নাম রাখা হয় কুরি ইনসটিটিউট অব রেডিয়াম। মাদাম কুরিই হলেন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বেসর্বা। ১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। মানবতাবাদী মাদাম কুরি আর ল্যাবরেটরির ঘরে আবদ্ধ থাকতে পারলেন না।
গবেষণা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর আবিষ্কৃত রেডিয়ামকে আহতদের চিকিৎসায় ব্যবহার করে তাদের সুস্থ করে তুলতে লাগলেন। চার বছর পৃথিবীময় মৃত্যুর তান্ডব ঘটিয়ে অবশেষে ১৯১৮ খ্রিঃ মহাযুদ্ধের অবসান ঘটল। মাদাম কুরিও আবার ফিরে গেলেন তার ল্যাবরেটরিতে।
মেরী কুরি র মৃত্যু: Marie Curie’s Death
দীর্ঘকাল তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করার ফলে মাদাম কুরির রক্তের কোষগুলি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ফলে ১৯৩৪ খ্রিঃ তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। সমস্ত চিকিৎসা ও চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেই বছরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বিশ্ববিজ্ঞানের এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভা।