বারাসাত বিদ্রোহ কি? বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন – Barasat Rebellion: বারাসাত বিদ্রোহ ছিল ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলায় প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন। সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন করতে যেয়ে তিতুমীর একটি শক্তিশালী সংগঠনভিত্তিক সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলে তা স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের ঈর্ষা ও ভয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। আর এই ভয় থেকে শুরু হয় তিতুমীরের সাথে স্থানীয় জমিদারদের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ।
জমিদারদের সাহায্যার্থে নীলকর ও নীলকুঠিয়ালরা এগিয়ে আসলে তাদের মিলিত শক্তি তিতুমীরের নিকট পরাজিত ও পর্যুদস্ত হতে থাকে। এমতাবস্থায় তিতুমীরকে দেশদ্রোহী হিসেবে অভিহিত করে জমিদার ও নীলকররা ইংরেজদেরকে তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত ও উত্তেজিত করে। ফলে ইংরেজরা তিতুমীরকে সমুচিত শাস্তিদানের হুমকি প্রদান করলে ১৮২৫ সালের দিকে তিতুমীর বারাসাত মহকুমাসহ চব্বিশ পরগনা জেলার কিয়দংশ, নদীয়া জেলার কিয়দংশ ও ফরিদপুরের কিয়দংশ সংযুক্ত করে ইসলামি আদর্শভিত্তিক একটি শোষণমুক্ত সমাজ ও স্বাধীন এলাকা গঠনের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন:
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন তিতুমির অর্থাৎ মির নিশার আলি। তিনি চব্বিশ পরগনার বারাসাত অঞ্চলে এই আন্দোলন করেছিলেন বলে একে বারাসাত বিদ্রোহও বলা হয়।
আঠারো শতকে মহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ওয়াহাবি কথার অর্থ হল নবজাগরণ।
তিতুমির মক্কায় গিয়ে সৈয়দ আহমেদের কাছ থেকে ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন এবং এরপর তিনি বাংলায় এসে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন।
তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ:
তিতুমির দেশীয় জমিদার, অত্যাচারী নীলকর ও সুদখোর মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে ইংরেজ শোষন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নদিয়া, যশোহর, রাজশাহি, মালদা, ঢাকা, পাবনা ও 24 পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলে যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তিনি জমিদার ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন এবং এতে জমিদার ও নীলকররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
তিতুমিরের ঘোষণা:
তিতুমির ঘোষণা করেন –
- ওয়াহাবি অনুগামীরা সুদে টাকা খাটানো পারবে না।
- ওয়াহাবিদের দাড়ি রাখতে হবে।
- মূর্তিপূজা ফয়তা, পির-পয়গম্বরের পূজার দরকার নেই।
ওয়াহাবিদের উপর অত্যাচার:
জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমীরের সংঘর্ষ শুরু হলে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীও তিতুমীরের বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নেমে পড়ে। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন, কেউ তিতুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে বা দাড়ি রাখলে তাকে জরিমানা দিতে হবে এবং কেউ তিতুকে বাড়িতে আশ্রয় দিলে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ:
বিভিন্ন কারণে তিতুর বাহিনীর সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের সংঘর্ষ বাধে। কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের গ্রাম আক্রমণ করে মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিলে তার সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ হয়। তিতুমির 300 জন অনুগামী সহ কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমন করলে সংঘর্ষ হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয় এবং বহু পুরোহিত নিহত হন।
বাদশাহ ঘোষণা ও বাঁশের কেল্লা তৈরি:
তিতুমির বারাসাত-বসিরহাট অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘোষণা করে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। মাইনুদ্দিন নামক জনৈক ওয়াহাবিকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ এবং তিনি তাঁর ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে সেনাপতি বলে ঘোষণা করেন। তিনি নারকেলবেরিয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত করেন। তিতুমির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খাজনা আদায় শুরু করেন।
24 পরগনা, ঢাকা, খুলনা, যশোহর, নদিয়া, রাজশাহী ও মালদা সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রসারিত হয়। যা আন্দোলন বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
বিদ্রোহের অবসান:
তিতুমিরের বিদ্রোহ জমিদার, নীলকর ও ইংরেজদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। 1831 সালের 14 ই নভেম্বর উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কামানের আঘাতের বাঁশেরকেল্লা উড়িয়ে দেন। তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেন।
তিতুমিরের 800 জন অনুগামী বন্দি হয় এবং গোলাম মাসুমের ফাঁসি হয়। চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ইংরেজ বাহিনী এই বিদ্রোহ দমন করে। তিতুমিরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বারাসাত বিদ্রোহের অবসান হয়।